‘যান্ত্রিক ত্রুটি, ইঞ্জিন বন্ধ’ এরপরই ছিনতাই

ছবি: সংগৃহীত

সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যাত্রী তুলে নিয়ে কিছু দূর যাওয়ার পর ইঞ্জিন বন্ধ করে দেওয়া হয়। চালক বলেন, ‘যান্ত্রিক ত্রুটি, ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে।’ কিছুক্ষণের মধ্যেই আরেকটি অটোরিকশা এসে থামে। কয়েকজন তরুণ দ্রুত নেমে এসে যাত্রীর মালামাল, অর্থ লুটে নিয়ে কেটে পড়ে। ছিনতাইয়ের আগে-পরে এই চক্রের সদস্যরা মুঠোফোনে কথা বলা থেকে বিরত থাকে।

এই অভিনব কায়দায় ছিনতাইয়ের ঘটনা রাজধানীতে অহরহ ঘটছে। এমন ছিনতাইকারী দলের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এই দলের নেতা আসাদ শেখ। তিনি পেশায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক। দলটি রাজধানীর গাবতলী, মহাখালী, কল্যাণপুর, সায়েদাবাদ ও কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে যাত্রী তুলে কিছুদূর যাওয়ার পর সব কেড়ে নিত।

পুলিশ বলছে, আসাদ শেখ দুই বছর ধরে ছয় সদস্যের ছিনতাইকারী দলের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। কখনো ধরা পড়েননি। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় আসাদসহ চক্রের চার সদস্যকে ধরে ফেলেছে পুলিশ। আদালত ও পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিও দিয়েছেন তাঁরা।

সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যাত্রী তুলে নিয়ে কিছু দূর যাওয়ার পর ইঞ্জিন বন্ধ করে দেওয়া হয়। চালক বলেন, ‘যান্ত্রিক ত্রুটি, ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে।’ কিছুক্ষণের মধ্যেই আরেকটি অটোরিকশা এসে থামে। কয়েকজন তরুণ দ্রুত নেমে এসে যাত্রীর মালামাল, অর্থ লুটে নিয়ে কেটে পড়ে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) রুবাইয়াত জামান প্রথম আলোকে বলেন, টানা ২১ দিনের চেষ্টায় আসাদ শেখকে তাঁরা গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছেন। পরে আসাদ শেখ আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে অন্যদের নাম প্রকাশ করেন। এরপর ঢাকা ও বরিশালে অভিযান চালিয়ে চক্রের আরও তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। আসাদ শেখের নেতৃত্বে চক্রের সদস্যরা প্রতি সপ্তাহে ঢাকায় ছিনতাই করতেন। ইতিমধ্যে শেরেবাংলা নগর ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার দুটি ছিনতাইয়ে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন আসামিরা।

অবশ্য আসাদ শেখের স্ত্রী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার স্বামী ঢাকায় ৩০ বছর ধরে সিএনজি চালিয়ে আসছেন। আমার জানামতে, উনি ছিনতাই কাজে জড়িত না।’

আসাদ শেখ

যেভাবে শনাক্ত ও গ্রেপ্তার

ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেন নজরুল ইসলাম। করোনার কারণে ঢাকা থেকে নাটোরে নিজ গ্রামে চলে যান। গত ৭ জুলাই নজরুল নাটোর থেকে বাসে করে রাত ১০টায় কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে এসে নামেন। মধ্য বাড্ডায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় রওনা হন। অটোরিকশাটি শেরেবাংলা নগরে এডিবি ভবনের সামনে এসে থেমে যায়। চালক বলেন, ইঞ্জিন বিগড়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অজ্ঞাত তিনজন সেখানে হাজির হন। তাঁরা অটোরিকশায় উঠে পড়েন।

নজরুল বলেন, ‘তিনজন লোক অটোরিকশায় ওঠার পর একজন আমাকে জাপটে ধরে। আমার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। আমি চিৎকার করার চেষ্টা করলে অটোরিকশার চালক গাড়ি ঘুরিয়ে সংসদ ভবনের আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে থাকে। পরে আমাকে নভোথিয়েটারের সামনে নামিয়ে দেয়। আমার কাছে থাকা একটি ল্যাপটপ এবং আড়াই হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়ে তারা চলে যায়।’

এ ঘটনায় নজরুল ইসলাম রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় গত ১১ জুলাই অজ্ঞাত ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলাটির তদন্তভার পান উপপরিদর্শক (এসআই) ওয়াজেদ আলী। ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যদের খুঁজে বের করতে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নেন তিনি। কল্যাণপুরের যে স্থান থেকে শিক্ষার্থী নজরুল অটোরিকশাটি ভাড়া করেছিলেন, সেখানকার আশপাশের ভিডিও ফুটেজ দেখে অটোরিকশাটি খুঁজে বের করে পুলিশ।

মিজান

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওয়াজেদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘টানা ২১ দিনের চেষ্টায় আমরা ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত অটোরিকশাটি উদ্ধার করতে সক্ষম হই। নজরুল ইসলামের ল্যাপটপ ছিনতাইয়ে সরাসরি জড়িত আসাদ শেখকেও গ্রেপ্তার করি। কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে পাওয়া ভিডিও ফুটেজ থেকে ধারণা নিয়ে অটোরিকশাটি উদ্ধারে গাবতলী, সায়েদাবাদ, কল্যাণপুরে ঘোরাঘুরি করি। ঢাকার সিএনজি গ্যারেজগুলোয় ঘোরাঘুরি করতে থাকি। গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে একটি অটোরিকশা দেখে আমার সন্দেহ হয়। তখন ওই অটোরিকশাকে অনুসরণ করতে থাকি। পরে সিএনজি চালককে ধরে থানায় নিয়ে আসি। জিজ্ঞাসাবাদে চালক আসাদ শেখ সব স্বীকার করেন। তাঁর নেতৃত্বে গত দুই বছরে বহু ছিনতাই সংঘটিত হয়েছে।’

আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে চালক আসাদ শেখ বলেন, ৭ জুলাই রাত সাড়ে ১০টার দিকে কল্যাণপুরের ইবনে সিনা হাসপাতালের সামনে থেকে এক যাত্রীকে অটোরিকশায় ওঠান। যাত্রী নিয়ে রওনা হওয়ার পর তাঁর পেছনে আরেকটি অটোরিকশা আসতে থাকে। এতে ছিনতাইকারী চক্রের সদস্য মিজান, কবির, জলিল ও চালক দেলোয়ার ছিলেন। অটোরিকশাটি যখন এডিবি ভবনের উল্টোদিকে আসে, তখন এটি বন্ধ করে দেন তিনি। এ সময় মিজান, কবির ও জলিল তাঁর অটোরিকশায় উঠে পড়েন। তাঁরা শিক্ষার্থী নজরুলের ল্যাপটপসহ টাকাপয়সা ছিনিয়ে নেন।

জলিল

আরেকটি ঘটনা

রেজাউল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি গত ১৯ জুলাই টাঙ্গাইল থেকে বাসে করে সন্ধ্যা সাতটার দিকে মহাখালী বাস টার্মিনালে নামেন। সেখান থেকে অটোরিকশা ভাড়া করে পুরান ঢাকার ওয়ারীর উদ্দেশে রওনা হন। এটি যখন তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার সাত রাস্তা মোড় পার হয়ে মগবাজার উড়াল সড়কে আসে, তখন হঠাৎ অটোরিকশাটি বন্ধ হয়ে যায়। এর দুই মিনিটের মধ্যে আচমকা তিনজন এসে অটোরিকশায় উঠে পড়েন। রেজাউলকে মারধর করে তাঁর কাছে থাকা ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়ে তাঁকে সাত রাস্তার কাছে নামিয়ে চলে যান। এ ঘটনায় রেজাউল তেজগাঁও থানায় মামলা করেন। এই মামলায় ২৩ আগস্ট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আসামি মিজানুর রহমান, যিনি আসাদ শেখের সহযোগী।

আদালতে জমা দেওয়া তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার প্রতিবেদন বলছে, ছিনতাইকারীরা ভুক্তভোগী রেজাউলের কাছ থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেন। আসামিরা সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য।

দেলোয়ার

মামলার তদারক কর্মকর্তা তেজগাঁও জোনের এডিসি রুবায়াত জামান বলেন, ‘এমন কোনো সপ্তাহ নেই যে আসাদ শেখের নেতৃত্বে ওই চক্রের সদস্যরা ছিনতাই করেনি। এরা সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে গাবতলীসহ বড় বড় বাসস্ট্যান্ডে বসে থাকত। এই চক্রের দুটি অটোরিকশা আছে। একটি চালাত আসাদ শেখ, অন্যটি দেলোয়ার। বাস ও রেলস্টেশনে আসা যাত্রীদের টার্গেট করত। অটোরিকশায় তুলে কিছুটা নির্জন স্থানে আসার পর ইঞ্জিন বন্ধ করে দিত। তখন পেছনে থাকা অন্যরা এসে যাত্রীর কাছে থাকা মালামাল কেড়ে নিত।’

আসাদ শেখের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে, দেলোয়ারের ঝালকাঠি আর জলিল শিকদার ও মিজানুর রহমানের বাড়ি বরিশাল। গ্রেপ্তার হয়ে তাঁরা এখন কারাগারে।

পুলিশ কর্মকর্তা রুবায়াত জামানের পরামর্শ হলো, ‘ছিনতাইকারীদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে যাত্রীদের। বেশির ভাগ যাত্রীর হাতে এখন স্মার্ট ফোন থাকে। সিএনজিতে ওঠার আগে যদি যাত্রীরা একটা ছবি তুলে রাখেন এবং সেই ছবি নিকটজনকে পাঠিয়ে রাখলে ভালো। এতে যাত্রীদের উপকার হবে। অটোরিকশা চালক বুঝবেন, তিনি নজরদারির মধ্যে আছেন।’