৩ দিন ধরে টিকার জন্য ঘুরছেন শারীরিক প্রতিবন্ধী রাজ্জাক

শারীরিক প্রতিবন্ধী আবদুর রাজ্জাক রাত তিনটা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন টিকা দেওয়ার জন্য। ছবিটি দনিয়ার স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ের সামনে বৃহস্পতিবার সকাল সাতটায় তোলা।
ছবি: প্রথম আলো

পঞ্চাশোর্ধ্ব শারীরিক প্রতিবন্ধী আবদুর রাজ্জাক পরিবার নিয়ে বসবাস করেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার দনিয়া এলাকায়। গত মঙ্গল ও বুধবার সকাল ছয়টার দিকে টিকা দেওয়ার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে আসেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের (দনিয়া) কার্যালয়ের সামনে। এসে দেখেছিলেন মানুষের দীর্ঘ সারি। তাই কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষার পর কাগজপত্র জমা না দিয়ে তিনি বাড়ি ফিরে যান। তবে আবদুর রাজ্জাক এরপর আর আগের দুই দিনের মতো ভুল করেননি। গতকাল বুধবার দিবাগত রাত তিনটার সময় তিনি চলে যান কাউন্সিলরের কার্যালয়ের সামনে। তিনি দেখেন, তাঁর সামনে আরও নয়জন জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দেওয়ার জন্য কাউন্সিলরের কার্যালয়ের সামনে অপেক্ষা করছেন। রাত তিনটার পর রাজ্জাক দেখতে পান, একে একে মানুষ জড়ো হচ্ছেন কাউন্সিলর কার্যালয়ের সামনে।

আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাতটার সময় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি একজন প্রতিবন্ধী মানুষ। টিকা দেওয়ার জন্য তিন দিন ধরে ঘুরতেছি। আজকে তো রাত তিনটা থেকে এখানে এসেছি। কিন্তু টিকা দিতে পারিনি। কবে নাগাদ টিকা দিতে পারব, সেটিও জানি না।’

আজ সকাল সাতটার দিকে স্থানীয় কাউন্সিলর জুম্মন মিয়া তাঁর কার্যালয়ের সামনে আসেন। তখন নারী ও পুরুষের লম্বা লাইন। মানুষ তাঁর কাছে অভিযোগ করতে শুরু করেন—দুই থেকে তিন দিন ধরে এসেও তাঁরা টিকে দিতে পারছেন না। তখন কাউন্সিলর উপস্থিত মানুষকে আশ্বাস দেন, নিশ্চয় আপনারা টিকা দিতে পারবেন।

টিকার জন্য রাত থেকে নারীদের দীর্ঘ লাইন।
ছবি: প্রথম আলো

সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল সাতটার দিকে কাউন্সিলর নিজেই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা সব নারী ও পুরুষের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেন। নারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সবাই যেন দুপুর ১২টার দিকে এখানে আসেন। আর পুরুষেরা যেন আসেন বেলা একটায়। কাউন্সিলরের এমন ঘোষণার পর সবাই বাড়ি ফিরে যান। তবে সকাল নয়টার সময় একদল মানুষকে টিকা দেওয়ার কার্ড দেওয়া হয়, যাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্র গতকাল সংগ্রহ করেছিলেন কাউন্সিলর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা।

স্থানীয় কাউন্সিলর জুম্মন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডে টিকা দেওয়ার কেন্দ্র মাত্র একটি। প্রতিদিন আমরা ৩০০ জনকে টিকা দিতে পারছি। কিন্তু টিকা দেওয়ার জন্য প্রতিদিন এক হাজারের মতো মানুষ এখানে ভিড় করেন। আমরা তো সবাইকে টিকা দিতে পারছি না। অনেকেই রাতের বেলায় এসে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। টিকার সরবরাহ বাড়ালে কিন্তু মানুষ এমন ভোগান্তির মধ্যে পড়তেন না।’

টিকার জন্য নির্ঘুম রাত

চার দিন ধরে টিকা দেওয়ার জন্য কাউন্সিলরের কার্যালয়ের সামনে এসেও টিকা দিতে পারেননি গৃহবধূ ফরিদা আক্তার। কারণ ভোরবেলা এসে দেখেন, মানুষের লম্বা লাইন। লম্বা সারির পেছনে পড়ে যাওয়ায় তিনি আর জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দিতে পারেননি। তবে গতকাল রাত ১১টার সময় কাউন্সিলরের কার্যালয়ের সামনে চলে আসেন ফরিদা। তখন থেকে আজ সকাল সাড়ে সাতটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন তিনি। এরপর কাগজ কাউন্সিলরের কাছে জমা দিতে পেরেছেন। কেবল ফরিদা নন, তাঁর মতো আরও অন্তত ১০ থেকে ১৫ জন নারী গতকাল রাত ১১টার সময় কাউন্সিলরের কার্যালয়ের সামনে এসে নির্ঘুম রাত পার করেছেন শুধু টিকা দেওয়ার জন্য।

রাত তিনটা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে ফারিয়া আক্তার।
ছবি: প্রথম আলো

ফারিয়া আক্তার নামের এক নারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিকা দেওয়ার জন্য তিন দিন ধরে ভোররাত থেকে এসে এখানে অপেক্ষা করছি। কিন্তু টিকা দিতে পারিনি। তাই তো গতকাল দিবাগত রাত দুইটার পর এখানে চলে এসেছি।

আর রাত ১১টার সময় আসা নিপা আক্তার নামের এক নারী বলেন, ‘টিকা দেওয়ার জন্য এমন ভোগান্তিতে পড়তে হবে, তা আমার জানা ছিল না। রাত ১১টার সময় এখানে এসে দাঁড়িয়েছি। নির্ঘুম রাত কাটল আমার। কাগজপত্র জমা নিয়েছে। কিন্তু কবে টিকা দিতে পারব জানি না।’

কাউন্সিলরের কার্যালয়ের সামনে লাইনে দাঁড়ানো বেশির ভাগ মানুষ কেউ দুদিন, কেউবা তিন দিন ধরে টিকা দেওয়ার জন্য আসছেন। কিন্তু টিকা তাঁরা দিতে পারছেন না।

৭৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ ফরিদ উদ্দিন রাত দুইটার সময় লাইনে এসে দাঁড়ান। সকাল সাতটার পর তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শারীরিক নানা জটিলতা আমার রয়েছে। তারপরও আমি গভীর রাতে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু আমার জাতীয় পরিচয়পত্রের কাগজ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু টিকা কখন পাব, তা জানি না।’

কাউন্সিলর জুম্মন মিয়া বলেন, ‘৩৪ বছর ধরে আমি এই এলাকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা আমার। মানুষ রাতে এসে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন, কষ্ট করতেছেন, এই দৃশ্য দেখে তো আমারও খারাপ লাগছে। কিন্তু আমরা তো এই কেন্দ্রে প্রতিদিন ৩০০ জনের বেশি টিকা দিতে পারছি না। সরকার যদি এই কেন্দ্রে টিকার সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়, তাহলে আমরা আরও বেশি মানুষকে টিকা দিতে পারব।’