৬ মাসেই মুখ থুবড়ে পড়ার দশা

ঢাকা নগর পরিবহনের যাত্রা শুরু হয় ৫০টি বাস দিয়ে। পর্যায়ক্রমে আরও ১০০ বাস নামানোর কথা ছিল।

বিআরটিসির বাস দিয়ে চালু রাখা হয়েছে ঢাকা নগর পরিবহনের সেবা। গতকাল দুপুরে কেরানীগঞ্জের ঘাটারচরে
প্রথম আলো

রাজধানীতে যাত্রী পরিবহনসেবায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামে যে বাসসেবা চালু হয়েছিল, তা মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। যাত্রা শুরুর ছয় মাসের মাথায় এই পরিবহনের অধীন চলা বাসের সংখ্যা ৫০ থেকে কমে ৩০–এ নেমেছে। যদিও কথা ছিল বাসের সংখ্যা পর্যায়ক্রমে বাড়বে।

কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে রাজধানী হয়ে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর রুটে ২১ কিলোমিটার পথে গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর চালু হয় ঢাকা নগর পরিবহন। তখন বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সভাপতি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছিলেন, এই রুটে পর্যায়ক্রমে ১০০টি বাস নামবে। ২০২৩ সালের মধ্যে পুরো ঢাকায় এই সেবা চালু হবে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক ২০১৫ সালে রুটভিত্তিক কোম্পানির অধীন বাসসেবা চালুর উদ্যোগটি নিয়েছিলেন। তখন বলা হয়েছিল, ঢাকার পুরোনো ও জরাজীর্ণ বাসগুলোকে সরিয়ে চার হাজার নতুন বাস নামানো হবে। একটি রুটে একটি কোম্পানির অধীন চালানো হলে বাসে বাসে প্রতিযোগিতা রোধ হবে, দুর্ঘটনা কমবে, শৃঙ্খলা ফিরবে। প্রায় ছয় বছর পর এই উদ্যোগের আংশিক বাস্তবায়ন করা হলেও এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠছে অব্যবস্থাপনা।

সপ্তাহখানেক আগে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ২০টি বাসের চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। যাত্রীদের অনেক চাহিদা থাকলেও বাস–সংকটের কারণে ঠিকমতো সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। যাত্রীরা দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর বাস না পেয়ে চলে যাচ্ছেন।
আবু বকর, টিকিট বিক্রেতা, ঘাটারচর যাত্রীছাউনি

গতকাল রোববার কেরানীগঞ্জের ঘাটারচরে গিয়ে দেখা যায়, এই রুটে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে যে ২০টি বাস নামানো হয়েছিল, সেগুলো আর চলছে না। বিআরটিসির ৩০টি বাসের মধ্যে ২৩ থেকে ২৫টি দোতলা বাস চলাচল করছে।

ঘাটারচর যাত্রী ছাউনিতে দায়িত্বরত টিকিট বিক্রেতা আবু বকর জানালেন, সপ্তাহখানেক আগে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ২০টি বাসের চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। যাত্রীদের অনেক চাহিদা থাকলেও বাস–সংকটের কারণে তাঁরা ঠিকমতো সেবা দিতে পারছেন না। যাত্রীরা দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর বাস না পেয়ে চলে যাচ্ছেন।

বিআরটিসির যেসব দোতলা বাস এই রুটে চলাচল করছে, সেগুলোতে আবার চালকের কোনো সহযোগী নেই। এতে বিড়ম্বনায় পড়ছেন চালকেরা। বিআরটিসির একটি বাসের চালক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সহযোগী না থাকায় টিকিট ছাড়াও যাত্রীরা উঠছেন। এত বড় গাড়ি একা সামলানো যায় না।

যেখানে–সেখানে থামে না, অন্য বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে না এবং টিকিট ছাড়া বাসে ওঠা যায় না—এসব কারণে ঢাকা নগর পরিবহন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ছয় মাসের মাথায় ঢাকা নগর পরিবহনের দুরবস্থায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সামিনা চৌধুরী নামের এক যাত্রী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাসটি নারীবান্ধব বলেই তাঁর মনে হয়েছে। কারণ, এই বাসে দৌড়ঝাঁপ করে উঠতে হয় না। যাত্রাও অনেকটা নিরাপদ। পুরোনো বাস হলেও অন্য বাসের চেয়ে সেবা ভালো ছিল।

সরেজমিনে দেখা যায়, ধানমন্ডি ১৫ নম্বর ও জিগাতলা (পূর্ব) কাউন্টারে টিকিট বিক্রেতা নেই। তবু যাত্রীরা বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। ধানমন্ডি ১৫ নম্বরে টিকিট কাউন্টারে অপেক্ষমাণ মনিরুল ইসলাম বলেন, আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করেও বাস পাওয়া যায় না।

ঢাকা নগর পরিবহনের বাসের চাকরি ছেড়ে দেওয়া একজন চালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা নিয়মিত বেতন পাচ্ছিলেন না। একজন চালককে দৈনিক আট ঘণ্টা করে ডিউটি করার কথা বলা হলেও বেশি সময় ধরে গাড়ি চালাতে হতো।

বাসমালিকদেরও লাভ হচ্ছে না বলে শুনেছেন। তাই আপাতত বাসগুলো ডেমরার কোনাপাড়া এলাকায় পার্কিং করে রাখা হয়েছে। আরেক চালক বলেন, বাস চালুর আগে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা রক্ষা না করার কারণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বাসগুলো সরিয়ে নিয়েছেন মালিকেরা।

নগর পরিবহনের অধীন ২০টি বাসে যাত্রীসেবা বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তার মাধ্যমে মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। মেয়রের বরাত দিয়ে জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের এ বিষয়ে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক নীলিমা আখতারের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

পরে এ বিষয়ে জানতে চাইলে নীলিমা আখতার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের হাতে আরও বাস রয়েছে। সেগুলো এই রুটে নামানোর চেষ্টা তাঁরা করছেন। চলতি মাসেই বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সভা আছে। ওই সভায় এসব বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে।

বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির ঘোষণা অনুযায়ী রাজধানীর আরও তিনটি রুটে ২২৫টি বাস নামানোর ঘোষণা দেওয়া আছে। পরীক্ষামূলক এই রুটে যাত্রীদের চাহিদা অনুযায়ী বাস না নামিয়ে নতুন রুটে বাস নামানো হলে এটি আদৌ সফল হবে কি না, তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে।