সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদার সময়েও সক্ষমতার ৪৪ শতাংশ ব্যবহার হয় না: সিপিডি

‘পরিবর্তনের পথে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত’ শীর্ষক ত্রৈমাসিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন উপস্থাপন করে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)
ছবি: সিপিডির সৌজন্যে

সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৮৩৪ মেগাওয়াট। এ সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে দিনে ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট। ১১ হাজার ৭৩৬ মেগাওয়াট সক্ষমতা বসিয়ে রাখতে হয়েছে। তার মানে সর্বোচ্চ চাহিদার সময়েও ৪৪ শতাংশ বিদ্যুৎ সক্ষমতা অলস ছিল। গড়ে ৫০ শতাংশের বেশি বসিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু উৎপাদন না করলেও দিতে হয় কেন্দ্র ভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ)।

‘পরিবর্তনের পথে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত’ শীর্ষক ত্রৈমাসিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় এসব তথ্য জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। জুলাই থেকে আগস্ট—তিন মাসের তথ্য পর্যালোচনা করে আজ ধানমন্ডিতে তাদের কার্যালয়ে এটি প্রকাশ করে তারা। এতে বলা হয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি ছিল। উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো হলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি নিশ্চিত করা যায়নি।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, শুরুতে কেন্দ্র ভাড়া দিয়ে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার যুক্তি ছিল। কিন্তু সক্ষমতা অতিরিক্ত করার পরও এটি এখন অর্থনীতির জন্য মাথা ব্যথা হয়ে গেছে। এটা থেকে বের হতে হবে। এ কেন্দ্রভাড়া বড় রকমের অপচয়। এ অপচয় নেওয়ার মতো সামর্থ্য এখন অর্থনীতির নেই। এখন কেন্দ্র ভাড়া দিয়ে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র করার কোনো যুক্তি নেই।

নিজস্ব গ্যাস সম্পদ আহরণে মনোযোগ না দিয়ে আমদানি নির্ভরতার কারণেই এখন বিল পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে পেট্রোবাংলা, বিপিসি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিপিডির পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশীয় গ্যাস উত্তোলনে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। অথচ এলএনজি আমদানি বাড়াতে নানা কিছু করা হচ্ছে। ৬৭ কোটি ডলার বিল বকেয়া বিপিসির। ৩০ কোটি ডলার বিল দিতে পারছে না পেট্রোবাংলা। দায় মেটাতে আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হচ্ছে।

এক প্রশ্নের জবাবে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এলএনজি আমদানির পাশাপাশি কয়লা আমদানি হচ্ছে। ডলারের সমস্যা সহজে সমাধান হবে না। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। এ সংকটের বড় উৎস হচ্ছে জ্বালানি খাত। এ খাতে ডলারের অপচয় বন্ধ করতে না পারলে ও বিকল্প জ্বালানির দিকে যেতে না পারলে ডলারের ক্ষয় কমিয়ে আনা কঠিন। ডলারের সংকট বাড়তে থাকবে। ঋণ করে বেশি দিন সংকট মোকাবিলা করা যাবে না।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সবকিছুর মূলে আছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের দায়মুক্তি আইন। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে চুক্তি করা হলে এতটা অসম হতো না। নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানিকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের নামের পাশে মালিকদের নাম বসালেই এমন একটি দারুণ যোগসূত্র পাওয়া যায়।

তিন মাসের মূল্যায়ন নিয়ে সিপিডির নিবন্ধে বলা হয়, গত জুলাইয়ে দিনে দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং হয়েছে। আগস্টে এটি কমে ৫০০ মেগাওয়াট হলেও রাতের লোডশেডিং কমেনি। এ সময় বিদ্যুৎ চাহিদা সবচেয়ে কম ছিল ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেট বিভাগে। অথচ এসব অঞ্চলেই লোডশেডিং করা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়নি। এ সময়ের মধ্যে গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। কিন্তু এলএনজি আমদানি বাড়ানোর একাধিক চুক্তি করা হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে এখনো জীবাশ্ম জ্বালানির (গ্যাস, কয়লা, তেল) ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর প্রবণতা দেখা গেছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রত্যাশিত অগ্রগতি হয়নি। নিবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা সহযোগী হেলেন মাশিয়াত।

সংকটের সাতটি কারণ চিহ্নিত করেছে সিপিডি। এর মধ্যে প্রথমেই আছে দুর্বল জ্বালানি নিরাপত্তাব্যবস্থা, বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল বকেয়া ও ডলারের অভাবে জ্বালানি আমদানি করতে না পারা। জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমিয়ে কয়লার ব্যবহার বাড়ানোর প্রবণতা দেখা গেছে। সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের দুর্বলতা বড়ভাবে চোখে পড়েছে। এসব দুর্বলতার কারণেই লোডশেডিং করতে হয়েছে। নিজস্ব গ্যাস সম্পদ আহরণে উদ্যোগ না নিয়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির দিকেই ঝোঁক ছিল সরকারের। নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের মনোভাব ইতিবাচক, কিন্তু এ–সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার ঘাটতি আছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণসহায়তার শর্ত হিসেবে প্রতিযোগিতামূলক জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের কথা ছিল, যা নির্বাচনের কারণে পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। দাম নির্ধারণের যে সূত্র তৈরি করা হয়েছে, তা যেন ন্যায্যতার ভিত্তিতে হয়, ভোক্তার ওপর দায় চাপানো যাবে না। নবায়নযোগ্য জ্বালানি কয়লার চেয়ে সস্তা জ্বালানিতে পরিণত হচ্ছে, এটাকে সরকারের গুরুত্ব দিতে হবে।