উন্মুক্ত উদ্যানে ইচ্ছেমতো স্থাপনা বানিয়ে ‘বাণিজ্য’ 

ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৭৫টি ওয়ার্ডে পার্ক বা উদ্যান রয়েছে মাত্র ২৭টি। এর মধ্যে ৬টি পার্কের নিয়ন্ত্রণে ইজারাদার। ঢাকা উত্তর সিটিতে পার্ক রয়েছে ২৩টি।

ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে পুরান ঢাকার নবাব সিরাজউদ্দৌলা পার্কে বিভিন্ন সরঞ্জাম বসানো হয়েছে। গত ২৬ আগস্ট
ছবি: প্রথম আলো

দেড় কোটি টাকা খরচ করে দুই বছর আগে পুরান ঢাকার নবাব সিরাজউদ্দৌলা পার্ক সংস্কার করেছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। তখন পার্কে (উদ্যান) কফির দোকান ও গণশৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই কফির দোকান এখন হয়ে গেছে খাবারের হোটেল। চা, সমুচা, শিঙাড়া, পরোটা, ডিম ভাজাসহ নানা পদের খাবার বিক্রি হয় সেখানে। আর গণশৌচাগার বন্ধ করে পণ্য রাখার গুদাম বানানো হয়েছে। 

পাশাপাশি পার্কের একাংশ দখল করে শিশু–কিশোরদের বিনোদনের নামে বসানো হয়েছে বিভিন্ন ধরনের রাইড (ট্রেন, নাগরদোলাসহ খেলার বিভিন্ন সরঞ্জাম)। এসব রাইড ব্যবহার করতে দিতে হয় ৩০-৫০ টাকা। ফলে সাধারণ মানুষের প্রবেশ সীমিত হয়ে গেছে সেখানে। মানুষের স্বস্তি–স্বাচ্ছন্দ্য নষ্ট করে এই উদ্যানকে ঘিরে বাণিজ্য করছে মূলত সিটি করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ইজারাদার। অবশ্য বাণিজ্যের এই কারবার শুধু নবাব সিরাজউদ্দৌলা পার্কেই হচ্ছে তা নয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটির আরও পাঁচটি উদ্যান এমন পরিণতি বরণ করেছে। দক্ষিণ সিটির ছয়টি পার্ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যাঁরা ইজারা নিয়েছেন, তাঁদের কেউ স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ভাতিজা কেউবা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা। আবার কেউ যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। 

ঢাকায় এমনিতেই পার্ক খুব একটা নেই। যে কয়টি আছে সেগুলোর পরিবেশও ভালো না। এর মধ্যে পার্ক ইজারা দিয়ে সিটি করপোরেশন বাণিজ্য করছে। কিন্তু সিটি করপোরেশন তো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হতে পারে না। দরকার হলে অন্য জায়াগায় তারা শিশুপার্ক করুক। উন্মুক্ত পার্কে রাইড বসিয়ে তাদের ব্যবসা করতে হবে কেন? 
বাসিন্দা মামুন হোসেন

ছয়টি পার্কের মধ্যে বাহাদুর শাহ পার্কের সবুজ চত্বর রক্ষায় এক বছর ধরে আন্দোলন করে আসছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সেখানে ইজারাদার স্থায়ী অবকাঠামো তৈরি করায় পার্কের প্রাণ–প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংসের প্রতিবাদে স্থানীয় মানুষ মানববন্ধন ও সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছেন। তাঁরা ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের কাছেও একাধিকবার স্মারকলিপি দিয়েছেন ইজারা বাতিলের জন্য; কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। 

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৭৫টি ওয়ার্ডের পার্ক বা উদ্যান রয়েছে মাত্র ২৭টি। রমনা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এই তালিকার বাইরে। এই দুটি উদ্যান দেখভালের দায়িত্ব গণপূর্ত অধিদপ্তরের। 

অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৪টি ওয়ার্ডে ২৩টি পার্ক রয়েছে। তারা কোনো পার্ক ইজারা দেয়নি। শুধু একটি পার্ক (গুলশানের বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ পার্ক) পরিচালনার দায়িত্ব তৃতীয় পক্ষকে দিয়েছে। এই পার্কের পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠান অবৈধ কোনো স্থাপনা নির্মাণ না করলেও পার্কের ভেতরে কফিশপ চালু করা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। 

পার্কে ইচ্ছেমতো দোকানপাট ও রাইড বসিয়ে বাণিজ্য করাটা নগরবাসীর বিনোদন সুবিধার অবাধ ও সর্বজনীন অধিকারের সঙ্গে প্রহসন বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পার্কে বাণিজ্যিক স্থাপনা থাকলে শুধু পরিবেশ-প্রতিবেশই নষ্ট হয় না, সাধারণ মানুষও পার্কে অবাধ ও নিরিবিলি পরিবেশে সময় কাটানোর অধিকার থেকে বঞ্চিত হন।  ঢাকা শহরে পার্ক ও গণপরিসরের সংকট এমনিতে অতি তীব্র। সিটি করপোরেশনের উচিত পার্কে থাকা বাণিজ্যিক স্থাপনা অপসারণ করে সাধারণ জনগণের জন্য সম্পূর্ণভাবে তা উন্মুক্ত করে দেওয়া। 

বছরে ২ লাখ ৩৭ হাজার টাকায় এই পার্কের কফির দোকান ও গণশৌচাগার ইজারা দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। সেই হিসাবে এই পার্ক থেকে সিটি করপোরেশন দৈনিক আয় ৬৫০ টাকা।
গুলিস্তানের শহীদ মতিউর রহমান পার্কে শিশু-কিশোরদের বিভিন্ন বিনোদনমূলক রাইড। গত ২৯ আগস্ট বিকেলে।
ছবি: দীপু মালাকার

পার্ক ‘গিলে’ খাচ্ছেন যুবলীগ নেতা

নবাব সিরাজউদ্দৌলা পার্কের মতোই যাত্রাবাড়ী পার্কেও (শহীদ শেখ রাসেল পার্ক) ক্যাফেটেরিয়া ও গণশৌচাগার বানিয়ে ইজারা দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে ১৮ কাঠার এই পার্কের ভেতরে শিশুপার্ক করা হয়েছে। এতে নাগরদোলা, ট্রেন, ঘোড়াসহ বিভিন্ন ধরনের খেলার সরঞ্জাম স্থাপন করা হয়েছে। যাত্রাবাড়ী মোড়ের এই পার্ক বছরে ১৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকায় ইজারা দিয়েছে সিটি করপোরেশন। 

গত ২৭ আগস্ট বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, পার্কজুড়েই ময়লা–আবর্জনা পড়ে আছে। পার্কের ভেতরে দুই সারিতে রিকশা ও ভ্যান রাখা। পার্ক লাগোয়া ফুটপাতের ফল বিক্রেতারা এই পার্ককে অনেকটা গুদাম হিসেবে ব্যবহার করছেন। পার্কের ভেতরে ১৪টি দোকান বসানো হয়েছে। 

স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, জেসমিন নামের এক নারী পার্কের ক্যাফেটেরিয়া ও গণশৌচাগার ইজারা নিয়েছেন। তিনি ৫০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সহসভাপতি স্বাধীনের (আনোয়ার হোসেন) স্ত্রী। ইজারার নামে তাঁরা এই পার্ক গিলে খাচ্ছেন। পার্ককে কেন্দ্র করে সেখানে সব দোকান থেকে টাকা নিচ্ছেন স্বাধীন। তাঁর সঙ্গে আছে ও ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হোসেনসহ কয়েকজন। পার্ক রক্ষার বিষয়টি তিনি মেয়রকে জানিয়েছেন। এ নিয়ে যাত্রাবাড়ী থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেছেন। দক্ষিণ সিটির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তাকেও বিষয়টি জানিয়েছেন। 

কাউন্সিলের করা অভিযোগের বিষয়ে আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাগজে–কলমে ক্যাফেটেরিয়া ও গণশৌচাগার ইজারার কথা বলা হলেও সব পার্কেই রাইড বসানো হচ্ছে। এটা করপোরেশন জানে। ’ 

কাউন্সিলর বলছেন, ‘আপনারা পার্ক গিলে খাচ্ছেন? ’ এর জবাবে আনোয়ার বলেন, ১৭ লাখ টাকায় পার্কের ইজারা নিয়েছেন। কিন্তু ক্যাফেটেরিয়ায় দিনে এক হাজার টাকাও বিক্রি হয় না। রাইড থেকেও আয় অনেক কম। এখন লোকসানে আছেন বলে দাবি করেন তিনি। 

বাণিজ্য করছেন কাউন্সিলরের ভাতিজা 

পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি পরিবেশে থাকা মানুষ একটু হলেও স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারতেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা পার্কে এসে। পার্কটির অবস্থান নয়াবাজার মোড় থেকে বাবুবাজার সেতুর দিকে যাওয়ার পথে হাতের বাঁ পাশে। এটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে।

কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়েই গুলিস্তানের শহীদ মতিউর রহমান পার্কে শিশু–কিশোরদের জন্য বিভিন্ন বিনোদনমূলক রাইড বসিয়ে চলছে বাণিজ্য। গত ২৯ আগস্ট বিকেলে
ছবি: দীপু মালাকার

বছরে ২ লাখ ৩৭ হাজার টাকায় এই পার্কের কফির দোকান ও গণশৌচাগার ইজারা দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। সেই হিসাবে এই পার্ক থেকে সিটি করপোরেশন দৈনিক আয় ৬৫০ টাকা। ইজারা দিয়ে গাছপালায় আচ্ছাদিত এই পার্ক কার্যত ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দার অনেকে। তাঁরা বলছেন, পার্কের ভেতরে শরবত, হালিম, ফুচকা-চটপটির দোকান বসিয়ে রীতিমতো বাণিজ্য করছেন ইজারাদার। 

পার্কের পাশেই লক্ষ্মীবাজার এলাকা। সেখানকার বাসিন্দা ও বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মামুন হোসেন সপ্তাহে অন্তত দুবার এই পার্কে হাঁটতে আসেন। গত ২৬ আগস্ট বিকেলে পার্কে বসেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় এমনিতেই পার্ক খুব একটা নেই। যে কয়টি আছে সেগুলোর পরিবেশও ভালো না। এর মধ্যে পার্ক ইজারা দিয়ে সিটি করপোরেশন বাণিজ্য করছে। কিন্তু সিটি করপোরেশন তো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হতে পারে না। দরকার হলে অন্য জায়াগায় তারা শিশুপার্ক করুক। উন্মুক্ত পার্কে রাইড বসিয়ে তাদের ব্যবসা করতে হবে কেন? 

ঢাকা দক্ষিণ সিটির সম্পত্তি বিভাগ সূত্র বলছে, পার্কের কফির দোকান ও গণশৌচাগার ইজারা নিয়েছেন স্থানীয় কাউন্সিলর মো. আ. মান্নানের ভাতিজা সাব্বির আহম্মেদ। তিনি যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

এই পার্কের ভেতরে ইজারাদার টিনের দুটি ঘরও বানিয়েছেন। সেই ঘরের একটিতে থাকেন একজন হালিম বিক্রেতা। আরেকটি ঘরে যাঁরা শিশুদের বিনোদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের রাইড পরিচালনা করেন, তাঁরা থাকেন। পার্কটির পাশের সড়কের সংস্কার কাজ চলছে। সেখানে কাজ করা নির্মাণশ্রমিকদের থাকার জন্য সম্প্রতি টিনের আরেকটি অস্থায়ী বড় ঘর করা হয়েছে পার্কের ভেতরে। 

ঢাকা দক্ষিণ সিটির সম্পত্তি বিভাগ সূত্র বলছে, পার্কের কফির দোকান ও গণশৌচাগার ইজারা নিয়েছেন স্থানীয় কাউন্সিলর মো. আ. মান্নানের ভাতিজা সাব্বির আহম্মেদ। তিনি যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ইজারা নিয়ে কফির দোকানকে খাবারের হোটেলে রূপ দিয়েছেন, গণশৌচাগারটি গুদাম হিসেবে ভাড়া দিয়েছেন। পাশাপাশি পার্কের ভেতরে এবং চারপাশে ছোট–বড় ১৬টি দোকান বসার সুযোগ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছেন। 

ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের দুজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এই পার্ককে বাড়তি আয়-রোজগারের একটা খাত বানিয়েছেন কাউন্সিলর ও তাঁর ভাতিজা। খাবারের দোকান ও গুদাম থেকে প্রতিদিন ওই দুজনের আয় সাড়ে তিন হাজার টাকা। আর পার্কের শিশুপার্ক থেকে প্রতি সপ্তাহে নেন ১০ হাজার টাকা। 

আর পার্কের একজন দোকানি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা প্রতিদিন কাউন্সিলরের লোকদের ৩০০ টাকা করে দেন। 

সে হিসাবে ১৪ দোকান থেকে আসে দিনে ৪ হাজার ২০০ টাকা। সব মিলিয়ে এই পার্ক থেকে ইজারাদারের আয় মাসে প্রায় আড়াই লাখ টাকা।

পার্কে দোকান বসিয়ে চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে গত ২৬ ও ২৯ আগস্ট কাউন্সিলর মো. আ. মান্নানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রথম আলো। কিন্তু কাউন্সিলর কার্যালয়ে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি। 

পরে পার্কের ইজারাদার ও কাউন্সিলরের ভাতিজা সাব্বির আহম্মেদের সঙ্গে ইজারার শর্ত ভঙ্গ এবং দোকান বসিয়ে চাঁদা আদায়ের বিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলে বলেন, তিনি এসবের কিছুই জানেন না। তবে কফির দোকান ও গণশৌচাগার ইজারা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন তিনি। 

পার্কের ভেতরে দোকান ভাড়া 

TANVIR AHAMMED

পুরান ঢাকার মাজেদ সরদার রোড এলাকায় সিক্কাটুলি পার্ক, গুলিস্তানে শহীদ মতিউর পার্ক (মহানগর নাট্যমঞ্চ) ও ধলপুরের আউটফল স্টাফ কোয়ার্টার পার্কেও শিশু পার্কের নামে রাইড বসিয়ে বাণিজ্য করা হচ্ছে। 

এর মধ্যে গুলিস্তানের শহীদ মতিউর রহমান পার্কে কেবল রাইডই বসানো হয়নি, সেখানে চারটি খাবারের দোকান, শিশুদের খেলনার দোকান, গহনার দোকানসহ বিভিন্ন ধরনের দোকান বসানো হয়েছে। যাঁরা শিশুদের খেলার সরঞ্জাম পরিচালনায় যুক্ত, তাঁদের থাকার জন্য পার্কের ভেতরে অস্থায়ীভাবে টিনের তিনটি ঘরও তৈরি করা হয়েছে। 

কাগজে–কলমে এই পার্ক বছরে ১৬ লাখ টাকায় ইজারা নিয়েছেন কাজী মো. তাজুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। জানা গেছে, তিনি গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক এক কর্মকর্তা ছিলেন। এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। 

 পার্কে রাইড বসিয়েছে শিফাত বিনোদন সার্ভিস অ্যান্ড মিডিয়া নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী এমরান হোসেন গত মঙ্গলবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, দক্ষিণ সিটির কাউন্সিলর আবুল ভাই (১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এনামুল হক ওরফে আবুল) পার্কের ইজারা নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকদের মধে৵ কাজ ভাগ করে দিয়েছেন। কেউ রাইড থেকে টাকা নিচ্ছেন। কেউ দোকান বসিয়ে টাকা নিচ্ছেন। একেকজনকে একেকভাবে কাজ দিয়ে আয় করার সুযোগ দিয়েছেন তিনি। 

বিষয়টি অস্বীকার করেননি কাউন্সিলর এনামুল হকও। গণশৌচাগার ও ক্যানটিনের ইজারা নিয়ে কীভাবে সেখানে রাইড ও দোকানপাট বসানো হলো—এমন প্রশ্নে বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে দেখার অনুরোধ জানিয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন,  ‘পার্কের পরিবেশ যাতে নষ্ট না হয়, সেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ 

গত ২৯ আগস্ট সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পার্কের পূর্ব পাশে ১১টি রাইড বসানো হয়েছে। সেখানে বিকট শব্দে গান বাজানো হচ্ছে। পার্কে কেউ গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করলে ৩০ টাকা করে দিতে হচ্ছে। আর শিশুদের রাইড ব্যবহারের জন্য ৪০–৬০ টাকা দিতে হচ্ছে। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পার্কে গিয়ে এসব রাইড ব্যবহার করা যাচ্ছে। 

সিটি করপোরেশন যেসব শর্তে ইজারা দিয়েছে তাতে পার্কের ভেতরে রাইড ও দোকানপাট বসানোর সুযোগ নেই। 

পাঁচটি পার্ক ইজারার নামে ইচ্ছেমতো স্থাপনা তৈরি করে বাণিজ্য করলে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, এ বিষয়ে প্রথম আলোর প্রশ্ন মনোযোগ দিয়ে শোনেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান। তবে তিনি কোনো জবাব না দিয়ে বিষয়টি নিয়ে করপোরেশনের সম্পত্তি বিভাগের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। 

দক্ষিণ সিটির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তার পদ এখন ফাঁকা আছে। এত দিন এই পদে থাকা কর্মকর্তা রাসেল সাবরিনকে সম্প্রতি শিল্প মন্ত্রণালয়ো বদলি করা হয়েছে। যে পাঁচটি পার্কে খাবারের দোকান ও শৌচাগার ইজারা দেওয়া হয়েছে, সেসব কার্যাদেশে তিনি সই করেছেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো পার্কেই রাইড বসাতে অনুমতি দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে কার্যাদেশে কঠোর শর্ত দেওয়া আছে। এসব শর্ত ভঙ্গ করলে বর্তমান প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে।’ 

আপনি দায়িত্বে থাকাকালীন এসব রাইড বসানো হয়েছে, এমন প্রশ্নে রাসেল সাবরিন বলেন, ‘কেউ কোনো অভিযোগ দেয়নি। আমাদেরও নজরে আসেনি। ’

উত্তর সিটিতে ভিন্ন চিত্র

ঢাকা উত্তর সিটিতে পার্ক আছে ২৩টি। এসব পার্ক আবার মাত্র ৯টি ওয়ার্ডের ভেতরে। এর মধ্যে ১ নম্বর ওয়ার্ডে (উত্তরা) ১টি, ২ নম্বর ওয়ার্ডে (মিরপুর) ১টি পার্ক এবং ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে (কারওয়ানবাজার) ১টি পার্ক রয়েছে। এ ছাড়া ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে (বারিধারা) রয়েছে ২টি পার্ক, মোহাম্মদপুর এলাকায় রয়েছে (২৯, ৩১ ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ড) ১০টি পার্ক। গুলশান–বনানীতে (১৯ নম্বর ওয়ার্ড) রয়েছে ৭টি পার্ক। এ ছাড়া ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে (ফার্মগেটে) একটি পার্ক ছিল, সেটি এখন মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। 

উত্তর সিটি কর্তৃপক্ষ ‘উন্মুক্ত স্থানের আধুনিকায়ন, উন্নয়ন ও সবুজায়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের আওতায় ১২টি পার্কের সংস্কার কাজ শেষ করেছে গত জুন মাসে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় পার্কে শিশুদের খেলার জন্য আলাদা ‘কিডস জোন’ করা দেয়। সেখানে খেলার বিভিন্ন সরঞ্জামও বসানো হয়। শিশুরা বিনা মূল্য খেলনাসামগ্রী ব্যবহার করতে পারে। পার্কে প্রবেশে টাকা দিতে হয় না। 

ঢাকা উত্তর সিটির সম্পত্তি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কম৴কর্তারা বলছেন, ইজারা না দিয়ে এসব পার্ক ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রস্তাব আহ্বান করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে গুলশান–২ নম্বরের বিচারপতি সাহাবুদ্দীন পার্কের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তিন বছরের জন্য ফাইবার সিকিউরেক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরও পাঁচটি পার্কের জন্য প্রস্তাব আহ্বান করা হয়েছিল। তিনটি হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। 

তবে গুলশান–২ নম্বরের বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ পার্কের ভেতরে কফিশপ চালু করা নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। এই পার্কসহ শহরের অন্যান্য পার্ক থেকে বাণিজ্যিক স্থাপনা অপসারণের দাবি জানিয়ে ১০ জন বিশিষ্ট নাগরিক গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিবৃতিও দিয়েছিলেন। তবে উত্তর সিটি কর্তৃপক্ষ পার্কের ভেতর কফিশপ চালু রেখেছে। 

ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আমাদের যেসব পার্ক ও মাঠের কাজ শেষ, সেগুলো পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় আগ্রহীদের ব্যক্তি ও সংস্থার কাছে প্রস্তাব আহ্বান করা হচ্ছে। তবে শর্ত রাখা হচ্ছে, নকশার বাইরে তাঁরা পার্কের ভেতরে কোনো স্থাপনা কিংবা বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন না। 

নগর–পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, কোনো নগর এলাকায় তিন শ্রেণির পার্কের পরিকল্পনা করতে হয়—হাঁটা দূরত্বে নেইবারহুড বা পাড়াভিত্তিক পার্ক, কমিউনিটি পর্যায়ে কমিউনিটি বা মহল্লাভিত্তিক পার্ক এবং নগরের বৃহৎ পরিসরে সিটি বা নগর পার্ক। ঢাকা শহরের জনসংখ্যা এবং আকার-আয়তন বিবেচনায় কেন্দ্রীয় মূল নগর এলাকায় হাঁটা দূরত্বে ৩০০ নেইবারহুড বা পাড়াভিত্তিক পার্ক এবং ৬০টি কমিউনিটি বা মহল্লাভিত্তিক পার্ক প্রয়োজন। ভূমি অধিগ্রহণ, ভূমি পুনর্বিন্যাস ও ভূমি পুনঃ উন্নয়নের মাধ্যমে এসব পার্ক তৈরির উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, জনগণের করের টাকায় উদ্যান বা পার্ক সংস্কারের পর যদি সেখানে নানা রকম স্থাপনা বসিয়ে বাণিজ্য চলে, সেটি হবে প্রতারণা। যদি পার্ক অনেক বড় হয়, তাহলে সেখানে ছোট পরিসরে শরীরচর্চা কেন্দ্র বা চা-কফিশপ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এসব করার ক্ষেত্রেও পার্কের মোট আয়তনের ৫ শতাংশের বেশি জায়গা ব্যবহার করা যায় না। সিটি করপোরেশন যদি পার্কগুলোকে বাণিজ্যিকায়ন করে থাকে, এটা অগ্রহণযোগ্য, পীড়াদায়ক।