শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ ও সভা-সমাবেশের অধিকার সংকুচিত হয়েছে: আসক

২০২৩ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে আজ সংবাদ সম্মেলন করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)ছবি: আসকের সৌজন্যে

রাজনীতি বা সংগঠন করার অধিকার এবং শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ ও সভা-সমাবেশ আয়োজন একটি সংবিধানসম্মত অধিকার। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে এ অধিকারচর্চার ক্ষেত্র ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) ২০২৩ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে এমন তথ্য উঠে এসেছে। আজ রোববার আসক আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়।

আসকের তথ্য মতে, বিদায়ী ২০২৩ সালে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংঘাতে অন্তত ৪৫ জন নিহত এবং অন্তত ৬ হাজার ৯৭৮ জন ব্যক্তি আহত হয়েছেন।

আসকের পর্যবেক্ষণ বলছে, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিদায়ী বছরে বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা, গায়েবি মামলা, হামলা, গ্রেপ্তার, পরিবহন ধর্মঘট ও বিরোধী দলের নেতা–কর্মীদের বাড়িতে গিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা ঘটেছে। শান্তি সমাবেশের নামে ক্ষমতাসীন দলের ধারাবাহিক রাজনৈতিক কর্মসূচি, পাশাপাশি বিরোধী দলগুলোর অবরোধ-ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতিকে আরও অস্থিতিশীল করেছে।

গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সারা দেশে দলটির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে ৫৩৪টি মামলা করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব মামলায় দলটির প্রায় ২০ হাজারের মতো নেতা–কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ সংখ্যাকে ১১ হাজার বলে দাবি করেছেন। এ ছাড়া মতপ্রকাশে বাধা, সাংবাদিক নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও হেফাজতে নির্যাতন, ধরে নেওয়ার পর গুমের ঘটনা বিদায়ী বছরেও অব্যাহত ছিল।

জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে এ সংবাদ সম্মেলন হয়। সেখানে ছিলেন আসকের চেয়ারপারসন জেড আই খান পান্না, নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল, জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক আবু আহমেদ ফয়জুল কবির, সমন্বয়ক তামান্না হক, নির্বাহী কমিটির সদস্য রওশন জাহান পারভীন। আসকের পর্যবেক্ষণে যেসব বিষয় উঠে এসেছে।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ

সারা বছরের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পর্যালোচনা করে আসক বলছে, আগের বছরগুলোর মতো এ বছরও নাগরিকের মতপ্রকাশ এবং শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়ার ও প্রতিবাদ করার অধিকার বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার অব্যাহত ছিল। ২৯ মার্চ প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের পদক্ষেপ প্রকৃতপক্ষে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করে, সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে।

বছরজুড়ে ২৯০ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি ও পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন বলেও আসকের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। এর মধ্যে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় হামলার শিকার হয়েছেন অন্তত ৭৮ জন সংবাদকর্মী। সংবাদ প্রকাশের জেরে বাংলা নিউজ২৪.কম জামালপুর প্রতিনিধি ও ৭১ টিভির বকশীগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিমকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃক লাঞ্ছিত ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় বাধা প্রদানের শিকার হয়েছেন ২২ জন সাংবাদিক।

বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার ২০ জন

২০২৩ সালেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি বলে আসকের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। আসক বলছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত ও সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা যায়নি। ২০২৩ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ২০ জন। এসব ঘটনার মধ্যে পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে কক্সবাজার জেলায় সাজেদুল ইসলাম মান্না এবং নারায়ণগঞ্জে র‌্যাবের গুলিতে আবুল কাশেম নিহত হন। এ ছাড়া পুলিশের হেফাজতে ১৩ জন, র‌্যাবের হেফাজতে ২ জন ও ডিবি (গোয়েন্দা) পুলিশের হেফাজতে ৩ জন নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। এর আগের বছর ২০২২ সালে ১৯ জন নাগরিক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। এ ছাড়া ২০২৩ সালে দেশের বিভিন্ন কারাগারে অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে মারা গেছেন ১০৫ জন। এর মধ্যে কয়েদি ৪২ এবং হাজতি ৬৩ জন। ২০২২ সালে কারা হেফাজতে মারা যান ৬৫ জন।

এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও গুমের ঘটনাও বন্ধ হয়নি বলেও আসকের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। ২০২৩ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ৯ জন অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। পরবর্তী সময়ে ছয়জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, ফিরে এসেছেন তিনজন।
প্রায় প্রতিবছরই ভারতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সীমান্ত হত্যা বন্ধে নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবায়িত হয়নি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের হিসাবমতে, ২০২৩ সালে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ কর্তৃক ৩০ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। ৩১ জন নাগরিক মারাত্মক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। উল্লেখ্য, ২০২২ সালে বিএসএফ কর্তৃক নিহত হন ২৩ জন বাংলাদেশি নাগরিক।

নারী ও শিশু নির্যাতন

নারীর প্রতি সহিংসতা ২০২৩ সালের আরেকটি উদ্বেগজনক বিষয় ছিল বলে আসকের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। বিশেষ করে ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণ–পরবর্তী হত্যা, যৌন হয়রানি, পারিবারিক নির্যাতনের নানা ঘটনাসহ শিশু হত্যা ও নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। বিগত বছরের মতো এ বছরও ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, পারিবারিক নির্যাতন, সালিস, ফতোয়াসহ নারীর প্রতি বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।

আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৩ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৫৭৩ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ–পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৩ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৫ জন। এ বছর পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন ৫০৭ জন নারী। এর মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা যান ২৯২ জন এবং আত্মহত্যা করেন ১৪২ জন। এ ছাড়া ২০২৩ সালে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৪২ জন নারী। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যার শিকার হন ৬৪ জন নারী এবং আত্মহত্যা করেন ৬ নারী। এ ছাড়া ৩২ জন নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মারা যান ছয়জন, এ ছাড়া রহস্যজনক মৃত্যু হয় একজনের। অন্যদিকে এ বছর অ্যাসিড নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন ১০ জন নারী।

হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, অনলাইনে যৌন হয়রানিসহ শিশুর প্রতি নানা সহিংসতার ঘটনা অব্যাহত ছিল ২০২৩ সালজুড়ে। আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের হিসাবমতে, ২০২৩ সালে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যু, ধর্ষণের পরে হত্যা, ধর্ষণচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা, অপহরণ ও নিখোঁজের পর হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে নিহত হয় কমপক্ষে ৪৮৪ শিশু। এ ছাড়া ২০২৩ সালে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয় কমপক্ষে ১ হাজার ১২ শিশু। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩১৪ শিশু, ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ১১৮ শিশু এবং বলাৎকারের শিকার হয়েছে ৭৫ ছেলেশিশু।