ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে খাল যেন ঘাসের মাঠ, ভাগাড়

ওয়াসার কাছ থেকে বুঝে নেওয়ার পর চারটি খালে ৯০০ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে দক্ষিণ সিটি। কাজ শুরু হয়নি।

১৫০ ফুট চওড়া খাল সংকুচিত হয়ে ১৫ থেকে ২০ ফুট হয়েছে। দীর্ঘদিন বর্জ্য অপসারণ না করার কারণে খালটির এমন দশা। গত শনিবার সকালে হাজারীবাগের কালুনগর খালেছবি: প্রথম আলো

ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে ২০২০ সালে দক্ষিণের খালগুলো বুঝে নেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ২০২২ সালে কালুনগর, জিরানী, মান্ডা ও শ্যামপুর খাল সংস্কারে ৮৯৮ কোটি টাকার প্রকল্পও নেওয়া হয়। তবু ২০২৪ সালে এসে খালগুলো যেন ঘাস চাষের মাঠ, ময়লার ভাগাড় হয়ে রয়েছে।

নতুন প্রকল্পের কাজ এখনো মাঠপর্যায়ে শুরু হয়নি। প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে বলে খালগুলোর নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমও দুই বছর ধরে বন্ধ। এদিকে বর্ষা মৌসুম ঘনিয়ে আসছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই চার খাল দিয়ে দক্ষিণ সিটির বহু এলাকার পানি নিষ্কাশিত হয়। যেহেতু খালগুলো পুনঃখনন করা হয়নি, পরিষ্কার করাও হয়নি, সেহেতু রাজধানীতে এবারও সড়কে জলজট তৈরির আশঙ্কা আছে।

২০২৩ সালে বর্ষা মৌসুমে প্রবল বৃষ্টিতে অন্তত ছয়বার ডুবেছিল ঢাকার বিভিন্ন এলাকা। এর মধ্যে গত ২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পর রাজধানীতে ব্যাপক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। সেদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা জলাবদ্ধ থাকে ঢাকা দক্ষিণ সিটির বেশির ভাগ এলাকার মূল সড়ক। রাস্তায় বহু যানবাহন বিকল হয়ে পড়েছিল।

এদিকে দেশে চলতি বছর বর্ষা মৌসুমে বাড়তি বৃষ্টি হওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে। আবহাওয়াবিষয়ক সংস্থা ‘সাউথ এশিয়া ক্লাইমেট আউটলুক’ বলছে, এবার বর্ষা মৌসুমে (জুন-সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ অঞ্চলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হবে। বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরও একই কথা বলছে। এসব পূর্বাভাস ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা বাড়াচ্ছে।

চারটি খাল পুনরুদ্ধার, সংস্কার ও নান্দনিক পরিবেশ তৈরির প্রকল্পের পরিচালক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খায়রুল বাকের মুঠোফোনে প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ইতিমধ্যে এসব খাল পরিষ্কারে তিনি ১৮টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিয়েছেন। কাজও শুরু হয়েছে। যেহেতু খালকে ঘিরে বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, তাই প্রথমে খালের জায়গা বুঝে নিতে গিয়ে কিছুটা সময় লেগেছে। তাঁরা যে খাল পরিষ্কার করেছেন, এর প্রমাণও তাঁদের কাছে রয়েছে।

অবশ্য গত শনিবার চারটি খালের বেশির ভাগ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সব কটি খালই বর্জ্য, আগাছা ও কচুরিপানায় ভরা। খালের কিছু কিছু অংশ থেকে বর্জ্য সরানো হয়েছে, তবে পানিপ্রবাহ পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। ওই দিন খাল পরিষ্কারের কাজ চলতে দেখা যায়নি।

৮৯৮ কোটি টাকার প্রকল্প

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার প্রধান চারটি খাল পুনঃখনন, সংস্কার ও নান্দনিক পরিবেশ তৈরির জন্য প্রায় ৮৯৮ কোটি টাকার প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পায় ২০২২ সালের অক্টোবরে। এটির মেয়াদ ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত।

দক্ষিণ সিটি সূত্র জানায়, খান পুনঃখনন ও সংস্কারের পাশাপাশি প্রকল্পের আওতায় চারটি খালের দুই পাড়ে দৃষ্টিনন্দন হাঁটার পথ বা ওয়াকওয়ে, বাইসাইকেল লেন, বাচ্চাদের খেলার মাঠ, মাছ ধরার ছাউনি, খাবার দোকান ইত্যাদি নির্মাণ করা হবে। নাগরিক সুবিধার জন্য খালগুলোর পাশে গড়ে তোলা হবে পদচারী-সেতু, বিপণিবিতান ও গণশৌচাগার।

দক্ষিণ সিটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ওয়াসার কাছ থেকে খালের দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর দুই বছর সব খালে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হয়েছিল। এতে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় তেমন একটা জলাবদ্ধতা হয়নি। বিষয়টি প্রশংসিত হয়েছিল। অবশ্য পরের দুই বছর খালের বর্জ্য অপসারণের কাজ বন্ধ ছিল।

সরেজমিন

দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, কাগজে-কলমে কালুনগর খালের দৈর্ঘ্য প্রায় আড়াই কিলোমিটার। প্রস্থ কোথাও ১৫ ফুট, কোথাও ১৫০ ফুট। খালটি শুরু হয়েছে হাজারীবাগের বেড়িবাঁধ থেকে। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সেটি মিশেছে রায়েরবাজারের স্লুইসগেটে।

কালুনগর খালের হাজারীবাগ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, খালটির বেশির ভাগ অংশই বর্জ্যে ভরা। একটি অংশ দিয়ে কোনোরকমে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, কয়েক মাস আগে খালের এক অংশ থেকে বর্জ্য সরিয়ে খালের মধ্যেই আরেক অংশে রাখা হয়েছিল। ওই অংশে আগাছা জন্মেছে। খালটির যে অংশ ১৫০ ফুট চওড়া, সেই অংশের ১০ থেকে ১৫ ফুট দিয়ে কোনোমতো পানি নদীর দিকে যেতে পারে।

শ্যামপুর খালে গিয়ে দেখা যায়, অবস্থা কালুনগর খালের মতোই। বেশির ভাগ অংশে পানির ওপর জমে আছে বর্জ্যের স্তূপ। কোথাও কোথাও জন্মেছে আগাছা। মানুষ ইচ্ছেমতো খালে বর্জ্য ফেলছে।

প্লাস্টিক বর্জ্যের স্তূপ জমেছে খালে। গত শনিবার শ্যামপুর খালের জিয়া সরণি এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

শ্যামপুর খালের দৈর্ঘ্য প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। কাগজে-কলমে এটির প্রস্থ কোথাও ১৫ ফুট, কোথাও ৩৫ ফুট। এটি পূর্ব জুরাইনের বড়ইতলা থেকে শুরু হয়ে জিয়া সরণি, মোহাম্মদবাগ হয়ে সিদ্ধিরগঞ্জের পাগলা খালে গিয়ে মিশেছে। শ্যামপুরের কদমতলীতে গিয়ে দেখা যায়, খালের ওপর একটি কালভার্ট নির্মাণের কাজ চলছে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে পানিপ্রবাহ। পানি জিয়া সরণি এলাকার সড়কে উঠে গেছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির সবচেয়ে বড় খাল মান্ডা। এর শুরু মানিকনগরে। এরপর উত্তর মান্ডা, সুখনগর, শেখের জায়গা ও খিলগাঁওয়ের ত্রিমোহনী হয়ে খালটি বালু নদে গিয়ে মিশেছে। এ খালের দৈর্ঘ্য সাড়ে আট কিলোমিটার। কাগজে-কলমে এর প্রস্থ কোথাও ১২ ফুট, কোথাও ৫০ ফুট।

সবুজবাগ থানার মান্ডা খালে গিয়ে দেখা যায়, সেটির প্রায় পুরো অংশেই ঘাস জন্মেছে। ৮ মে মুগদায় মান্ডা খাল পুনরুদ্ধার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টির কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। অবশ্য স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, উদ্বোধন হলেও কাজ শুরু হয়নি।

মান্ডা এলাকার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দেড় বছরের বেশি সময় মান্ডা খাল থেকে বর্জ্য অপসারণ করা হয়নি। সম্প্রতি মাপজোখ করতে দেখা গেছে।

জিরানী খালের শুরু সবুজবাগের কুসুমবাগ সেতুর নিচ থেকে। প্রায় চার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে খালটি ত্রিমোহনী বাজার-সংলগ্ন বালু নদে মিশেছে। কাগজে-কলমে খালটির দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে আট কিলোমিটার। প্রস্থে কোথাও ২০ ফুট, কোথাও ৫০ ফুট। গত শনিবার গিয়ে দেখা যায়, অন্য খালের মতোই এটি বর্জ্য ও আগাছায় ভরা। বিভিন্ন জায়গা সরু হয়ে যাওয়ায় খালটি দিয়ে পানি ঠিকমতো প্রবাহিত হতে পারছে না। এই খাল পরিষ্কারের কোনো কার্যক্রমও চোখে পড়েনি।

‘এবারের বর্ষায়ও মানুষকে ভুগতে হবে’

জিরানী খাল খননের বিষয়ে জানতে চাইলে ২০২৩ সালে মে মাসে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেছিলেন, মাস দুয়েকের মধ্যে তাঁরা মাঠপর্যায়ে খননের কাজ শুরু করতে পারবেন। এরপর পেরিয়েছে এক বছর। যদিও কাজ শুরু হয়নি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের টাকায় খাল পরিষ্কার হবে, এ ধারণা নিয়ে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বর্জ্য অপসারণের কাজ বন্ধ রাখা উচিত হয়নি। কারণ, খালের বর্জ্য পরিষ্কার করা করপোরেশনের নিয়মিত কাজেরই অংশ। অন্যদিকে বড় প্রকল্প পাওয়ার পরও কাজ পুরোদমে কাজ শুরু না হওয়ায় এবারের বর্ষায়ও মানুষকে ভুগতে হবে।