যানজট, দূষণ, দখলসহ নানাবিদ সমস্যায় জর্জরিত ঢাকা এখন মৃত নগরীতে পরিণত হয়েছে। নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ হিসেবে এ জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (রাজউক) দায়ী করেছেন বক্তারা। ঢাকাকে বাঁচাতে হলে দুর্নীতি বন্ধ করা এবং রাজধানীর বিকেন্দ্রীকরণের পরামর্শও দেন তাঁরা।
আজ বুধবার সকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘ড্যাপ নিয়ে জটিলতা: টেকসই নগরায়ণ প্রসঙ্গ’ শীর্ষক এক নাগরিক সংলাপে এসব কথা উঠে আসে।
ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে ২০২২ সালের ২৩ আগস্ট বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ ২০২২-৩৫) গেজেট প্রকাশ করে রাজউক। এর পর থেকেই এর সংশোধন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তৈরি হয়েছে মতপার্থক্য। এ কারণে আটকে আছে ড্যাপের বাস্তবায়ন। এমন বাস্তবতায় এ সংলাপের আয়োজন করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)। সংলাপে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, গবেষকসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
সংলাপে দুর্নীতিকে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে চিহ্নিত করেন সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবির। তিনি বলেন, ঢাকা বেড়ে উঠেছে বিশৃঙ্খলভাবে। এর পেছনে দায়ী দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনা।
সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী বলেন, এখানে আমলারা রাজনীতিবিদদের দোষারোপ করে আর রাজনীতিবিদেরা আমলাদের। এই দুটি শক্তি দেশকে তছনছ করে দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, দুর্নীতি বন্ধ করলে দেশের অনেক সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘ঢাকা মরে গেছে। ঢাকা বেঁচে নেই।…ঢাকার মৃত্যুর কারণের জন্য রাজউককে আমরা দায়ী করব।’
রাজধানীর বিকেন্দ্রীকরণ না করাকে মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে শামীম হায়দার বলেন, চিকিৎসা, চাকরি, জীবিকা—সবকিছুর জন্য মানুষকে ঢাকামুখী হতে হচ্ছে। ঢাকার গুরুত্ব কমিয়ে ফেলতে হবে। গ্রামগুলোতে নগরের সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে ঢাকার ওপর চাপ কমবে। এটা ছাড়া ঢাকাকে বাঁচানো যাবে না।
আবাসন নির্মাণ খরচ বেড়েছে
সংলাপের শুরুতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক পারভেজ করিম আব্বাসী। প্রবন্ধে বলা হয়, রাজউকের ড্যাপ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল জনসংখ্যার ঘনত্ব কমানো এবং নগরের বাসযোগ্যতা বাড়ানো। তবে এই প্রকল্পের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতিতে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) করার কারণে আবাসন নির্মাণ খরচ বেড়েছে। ফলে ব্যবসায়ী ও জমির মালিকেরা নতুন আবাসন নির্মাণে আগ্রহ হারাচ্ছেন।
প্রবন্ধে আরও বলা হয়েছে, ড্যাপে ধানমন্ডি-গুলশানের মতো পরিকল্পিত আবাসিক এলাকায় এফএআর বেশি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অথচ অপরিকল্পিত এলাকাগুলো, যেখানে রাজধানীর বেশির ভাগ মানুষ বাস করে, সেখানে কম এফএআর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
পারভেজ করিম আব্বাসী বলেন, রাজউকে নির্বাচিত প্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে স্বাধীন পরিচালক নিয়োগ দেওয়া উচিত। দুর্নীতি কমাতে রাজউকের সব আবেদনপ্রক্রিয়া ডিজিটালাইজেশন করতে হবে। একই সঙ্গে নগরের মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও ভাসমান জনগোষ্ঠীর জন্য আবাসন নিশ্চিত করতে হবে।
টাকা ছাড়া রাজউকে কাজ হয় না
আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সহসভাপতি আবদুর রাজ্জাক বলেন, এলাকাভেদে এফএআরের মান আলাদা করা হয়েছে। কোথাও ৫ তলা ভবনের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে, আবার কোথাও ১০ তলার। এই আচরণ বৈষম্যমূলক। এতে ভবন নির্মাণে জমির মালিকেরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। তিনি বলেন, টাকা ছাড়া রাজউকে কোনো কাজ হয় না। এসব যন্ত্রণা নিয়েই আবাসন ব্যবসায়ীদের কাজ করে যেতে হচ্ছে।
ড্যাপকে ‘মরণফাঁদ’ আখ্যা দিয়ে ঢাকা সিটি ল্যান্ড ওনারস অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক দেওয়ান এম এ সাজ্জাদ বলেন, ড্যাপে মহানগরকে বিভক্তির মাধ্যমে চরম বৈষম্য করা হচ্ছে। এটাকে বন্ধ করতে হবে। ড্যাপকে পক্ষপাতহীনভাবে সংশোধন করে জনবান্ধব করতে হবে।
ভূমিকম্প হলে উদ্ধারকাজ করা যাবে না
সংলাপে ঢাকার অপরিকল্পিত নগরায়ণের নেতিবাচক প্রভাব প্রসঙ্গে আলোচনায় একাধিক বক্তার বক্তব্যে ভূমিকম্পের বিষয়টি উঠে আসে। বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটলে উদ্ধার তৎপরতা চালানোও কঠিন হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন অনেকে।
সাবেক সংসদ সদস্য নিলুফার চৌধুরী মনি বলেন, নগরের এমন অনেক জায়গা রয়েছে, যেখানে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারে না। খালগুলো দখল হয়ে গেছে। অগ্নিদুর্ঘটনার সময় পানি পাওয়া যায় না। বড় বড় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির পরও আবাসিক এলাকায় এখনো রাসায়নিক গুদাম রয়ে গেছে।
বাঁচানোর উপায় কী
ঢাকাকে বাঁচাতে নীতিনির্ধারকসহ সবার মনোজাগতিক ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি বলে মনে করেন সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (এসডিএফ) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। তিনি বলেন, কনসিসটেন্সি (ধারাবাহিকতা), কো–অর্ডিনেশন (সমন্বয়) ও কমপ্লায়েন্স (আইন মেনে চলা)—এই তিনটি ‘সি’র ওপর নজর দিতে হবে। যে আইন প্রণয়ন করা হবে, তার ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। বারবার আইন পরিবর্তন করা যাবে না।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন (প্রিন্স) বলেন, প্রতিবছর ঢাকার জনসংখ্যা বাড়ছে। উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর সমস্যা সমাধান করতে না পারলে এই হার আরও বাড়বে। ফলে রাজধানীর বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া উপায় নেই। এ সময় দক্ষ ও সমতাভিত্তিক নগরের দাবি জানান তিনি।
ঢাকাকে পুনর্গঠন করতে একক শাসনব্যবস্থার পরামর্শ দেন রিকন্ডিশন্ড গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বারভিডার সভাপতি আবদুল হক। তিনি বলেন, সংকট থেকে ঢাকাকে বাঁচাতে নতুন সরকারের চিন্তা করতে হবে। ঢাকা মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্টের আওতায় অনেকগুলো পৌরসভা গঠন করা যেতে পারে। এর সঙ্গে পরিবহন, সবুজ আবাসনের মতো বিষয়গুলোও যুক্ত হতে হবে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান বলেন, ঢাকা শহরে মানুষের আসা বন্ধ করতে হবে। জেলাগুলোতে শিক্ষার মান ও কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে ঢাকার বাইরে যাঁরা চাকরি করতে আগ্রহী হবেন, তাঁদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে।
ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চেয়ারম্যান প্রীতি চক্রবর্তী বলেন, নাগরিক জীবন, ব্যবসা—সবকিছুতেই ড্যাপের প্রভাব রয়েছে। তাই সবাইকে সঙ্গে নিয়ে টেকসই নীতি গ্রহণ করতে হবে।
এ ছাড়া সংলাপে বক্তাদের কেউ কেউ রাজউককে শুধু রাজধানী উন্নয়নের জন্য রেখে ভবন নির্মাণ ও দেখভালের জন্য একটি আলাদা অধিদপ্তর করার প্রস্তাব করেন।
সিজিএসের সভাপতি জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় সংলাপে আরও বক্তব্য দেন সাংবাদিক এম এ আজিজ, স্থপতি সরদার আমিন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন, আইনজীবী মুজিবর রহমান, সেন্টার ফর এনআরবির চেয়ারপারসন এম এম এস সেকিল চৌধুরী, বিএনপি নেত্রী ফারজানা শারমিন প্রমুখ।