পুরান ঢাকায় এক বাড়িতে সচল দুটি কুয়া
ঢাকায় সচল কুয়া এখন বিরল। ফরাশগঞ্জের বাড়ির কুয়া দুটি শতবর্ষী বলে ধারণা এলাকাবাসীর।
পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জে মোহিনী মোহন দাস লেনের এক পুরোনো বাড়ি। স্মৃতিমাখা দরজা, উঠানে বর্ষীয়ান গাছ, দেয়ালে মোগল আমলের নকশা—সব মিলিয়ে অনেক ঐতিহ্যবাহী বাড়ির মতোই একটি। তবে এই বাড়ির বিশেষত্ব ভিন্ন জায়গায়—এখানে এখনো টিকে আছে দুটি সচল কুয়া। বারো পরিবারে ভাগ হয়ে যাওয়া বাড়িতে দুটো কুয়াই এখনো নিয়মিত ব্যবহার করেন সবাই।
১৭ সেপ্টেম্বর দুপুরে মোহিনী মোহন দাস লেনের এ বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, মূল প্রবেশপথের ডান দিকে থাকা কুয়া থেকে পানি তুলে কাপড় ধুচ্ছেন এক বাসিন্দা। তিনি জানালেন, এখন পানি অনেকটা নেমেছে, তবে বর্ষায় পানি কুয়ার মুখ পর্যন্ত চলে আসে। এটি বাড়ির প্রথম কুয়া। কয়েক পরিবারের ঘর অতিক্রম করে বাড়ির পেছন দিকে গিয়ে মন্দিরের কাছে দ্বিতীয় কুয়াটি। সেখানে একটু গাছপালা আছে। কুয়াটি খানিকটা উঁচু দেখে বোঝা যায় পরে বাঁধানো হয়েছে। এর দেয়ালটাও চওড়া। পানিটা তুলনামূলক স্বচ্ছ, ওপরের গাছের প্রতিবিম্ব স্পষ্ট দেখা গেল কুয়ার পানিতে।
এই বাড়ির তৃতীয় তলায় থাকেন প্রয়াত আলোকচিত্রী বিজন সরকারের ছেলে জয়ব্রত সরকার। তিনি বলেন, ‘দুই দশক আগে এক লোক এসে পরিষ্কার করেছিলেন। হাড়জিরজিরে সেই ব্যক্তি একদমে কুয়ার তলা থেকে মাটি তুলে এনেছিলেন। এরপর আর পরিষ্কার করতে দেখিনি। তবে আমাদের নবতিপূর্ণা এক বাসিন্দা বলেছেন, জন্মের পর থেকেই কুয়াগুলোকে এমন অবস্থায় দেখছেন।’
ফলে ধারণা করা হয়, কুয়াগুলো অন্তত শতবর্ষী। সম্ভবত আরও পুরোনো।
ঢাকায় সচল কুয়া এখন বিরল। গেন্ডারিয়ার কালীচরণ সাহা লেনের ১০ নম্বর খাজাঞ্চি বাড়িতে এখনো তিনটি কুয়া আছে, তবে ব্যবহৃত হয় না বলে জানালেন এ বাড়ির বাসিন্দা দীপ্রদাস। নারিন্দা ও শাঁখারীবাজারের কিছু বাড়িতেও কুয়ার খোঁজ মেলে। তবে একই বাড়িতে দুটি সচল কুয়ার কথা আর শোনা যায়নি।
গত বছর ফরাশগঞ্জের বি কে দাস লেনের ‘বড়বাড়ি’ নামে পরিচিত ঐতিহাসিক বাড়িটিতে সচল কুয়া দেখেছিলাম। সম্প্রতি গিয়ে দেখা গেল, কুয়াটি ভরাট করে দেওয়া হয়েছে। এখানকার একজন নির্মাণশ্রমিক বললেন, এখন কলের পানিই যথেষ্ট। তাই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবু সেই হারিয়ে যাওয়া কুয়ার জায়গাটি খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, সঙ্গে থাকা প্রাচীরের গায়ে ঐতিহ্যময় কারুকাজ এখনো রয়েছে। কুয়াটি ঢেকে গেছে বাতিল কাঠ আর এক টুকরো টিনে।
ঢাকার মানুষ একসময় বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার পানির ওপর নির্ভর করত। তবে বাড়ি বাড়ি পানির একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস ছিল কুয়া। পানির স্তর নেমে যাওয়ায় এসব কুয়া পরিত্যক্ত হয়েছে আরও অনেক আগেই। তবু এই জোড়া কুয়ায় কেমন করে বারো মাস পানি থাকে! এসব নিয়ে জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের জ্যেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ ইসমাত আরা পারভিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকায় সচল কুয়া পাওয়া বিস্ময়কর। এখন ১০০–২০০ ফুট গভীর থেকে পানি ওঠে না। ২০০ ফুটের নিচে গিয়ে লোয়ার লেয়ার থেকে পানি তুলতে হয়। সাধারণত কুয়া ৩০ থেকে ৬০ ফুট গভীর হয়। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না হলে এগুলো ভরাট হয়ে যায়।’ তিনি মনে করেন, কুয়াগুলো শতবর্ষী হলে তা শুধু পানির উৎস নয়, ঐতিহাসিক নিদর্শনও বটে।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের নব্বইয়ের দশকের নাটকে দেখা যেত পাতকুয়ার পাশে গৃহকর্মীরা কাপড় ধুচ্ছেন বা বাসন মাজছেন। যদিও এসব ছিল মঞ্চের মধ্যে বানানো কুয়া। তখনো মানুষ স্মৃতিতে কুয়া ধরে রাখতে চাইতেন বোঝা যায়। যদিও ঢাকায় কুয়া হারিয়েছে আরও আগেই। তাই এখন সচল কুয়ার খবর পেলে তা দর্শনের ব্যাপার হয়ে ওঠে আমাদের জন্য। যদিও মোহিনী মোহন দাস লেনের এই পুরোনো বাড়ির বাসিন্দাদের কাছে ব্যাপারটা তেমন নয়। তাঁরা মনে করেন, নিয়মিত পানি তোলা হয়, তাই কুয়া সচল আছে।
কুয়া দুটির সঙ্গে টেকনাফের মাথিনের কূপ বা সিরাজগঞ্জের বেহুলার কূপের মতো কোনো কিংবদন্তি নেই। তবে বহুকালের অনেক ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে আছে কুয়া দুটি। এখনো মানুষের জন্য পানি সরবরাহ করে চলেছে। তাই নিজেই যেন স্মারক হয়ে উঠেছে কুয়াগুলো।