মেয়র যে খালে নৌভ্রমণ করেছিলেন, সেটির এখন কী অবস্থা

বছরখানেক আগে ঢাকার মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর খালের পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে খালটি এখন মৃতপ্রায়।

সংস্কারের পর মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর খালে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলামের নৌকাভ্রমণ
ফাইল ছবি

দলবল নিয়ে নৌকায় করে ঢাকার রামচন্দ্রপুর খাল পাড়ি দিচ্ছেন মেয়র আতিকুল ইসলাম—এ রকম একটি ছবি বছরখানেক আগে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছাপা হয়েছিল। মেয়র ও তাঁর সঙ্গীদের ১০টি নৌকা তিন কিলোমিটার দীর্ঘ রামচন্দ্রপুর খাল পেরিয়ে বুড়িগঙ্গা নদী পর্যন্ত গিয়েছিল। চেষ্টা–সদিচ্ছা থাকলে মৃতপ্রায় খালেও যে ‘প্রাণ’ ফিরিয়ে আনা যায়, মেয়রের ওই নৌকাভ্রমণ ছিল তার বড় উদাহরণ। এ নিয়ে তখন ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় বেশ আলোচনাও হয়েছিল।

‘প্রাণ’ ফিরে পাওয়া সেই খাল দেড় বছরের মধ্যেই আবার মরতে বসেছে। ভরাট হয়ে, আবর্জনা জমে কোথাও কোথাও এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে যে খাল খুঁজে পাওয়াই কঠিন। মোহাম্মদপুরের বছিলার লাউতলা থেকে রামচন্দ্রপুর খালের শুরু।

এরপর খালটি এঁকেবেঁকে মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান, সাতমসজিদ আবাসিক এলাকা হয়ে চন্দ্রিমা হাউজিং ও বছিলা গার্ডেন সিটির মধ্য দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়ে মিশেছে। এই খালটির দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ১০ কিলোমিটার। প্রস্থে কোথাও ৩০ ফুট, কোথাও ২০ ফুট।

খালে তরল এবং কঠিন বর্জ্য যাতে না পড়ে এবং খাল যাতে দূষিত না হয়, সে ধরনের পরিকল্পিত ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ সিটি করপোরেশনের নেই।
স্থপতি ইকবাল হাবিব

গত বছর রামচন্দ্রপুর খাল খনন, পরিষ্কার ও সংস্কারের কাজ করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এতে খালে পানির প্রবাহ ফিরে এসেছিল। নৌকা চলার মতো উপযোগী পরিবেশও ফিরেছিল। কিন্তু নিয়মিত তদারকি না থাকা এবং আবর্জনা পরিষ্কার না করায় খালটি আবার ‘হারিয়ে’ গেছে।

গতকাল মঙ্গলবার ও গত শনিবার—এই দুই দিন রামচন্দ্রপুর খালের লাউতলা অংশ থেকে বুড়িগঙ্গা নদীর সংযোগস্থল পর্যন্ত ঘুরে দেখেন প্রথম আলোর প্রতিবেদক ও আলোকচিত্রী। দেখা যায় খালের বেশির ভাগ অংশে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ জমে আছে। আবর্জনার স্তূপের ওপর অনেক জায়গায় জন্মেছে ঘাস ও আগাছা। কোনো কোনো অংশে ঘন কচুরিপানার স্তর। খালের গভীরতাও কমে গেছে। আশপাশের বাসিন্দারাও খালের পাড়ে ময়লা ফেলছেন। অন্তত সাতটি জায়গায় বাসিন্দাদের ফেলে দেওয়া বর্জ্যের স্তূপ দেখা গেছে।

অন্যদিকে খালপাড়ের খালি প্লটগুলোয় বহুতল ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। সিটি করপোরেশনের তদারকি না থাকায় ভবনমালিকেরা নির্মাণকাজের উচ্ছিষ্ট ইট, সিমেন্ট ও কংক্রিটের ভাঙা টুকরো খালে ফেলেছেন। পাড়ে থাকা গরুর খামারের বর্জ্যও সরাসরি খালে ফেলা হচ্ছে। 

প্রতিশ্রুতি যখন ‘কথার কথা’

রামচন্দ্রপুর খাল খনন ও পরিষ্কার করার কাজ শুরু হয়েছিল গত বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি। একটি ভাসমান খননযন্ত্র (এক্সকাভেটর) ভাড়া নিয়ে টানা ৪০ দিন খালের খননকাজ করা হয়। সংস্কার শেষে গত বছরের ৩১ মার্চ খালে নৌকাভ্রমণের আয়োজন করেন ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম। সেদিন তিনি কিছু প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। সাংবাদিকদের মেয়র তখন বলেছিলেন, খাল পরিষ্কার রাখা ও তদারকির জন্য বিশেষ দল গঠন করবেন। খাল রক্ষায় পাড়ে বসাবেন ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা। মানুষের যাতায়াতের সুবিধার জন্য খালে নৌকা চলবে, এ জন্য ২০টি যন্ত্রচালিত নৌকার লাইসেন্সও দেওয়া হবে।

মেয়র আতিকুল স্বপ্ন দেখেছিলেন ওই খালকেন্দ্রিক নৌ চলাচলব্যবস্থা গড়ে তোলার। কিন্তু পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতির কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। শুধু চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মেয়র একবার রামচন্দ্রপুর খাল পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন। আবর্জনা ফেলার দায়ে খালপাড়ের একটি গরুর খামারকে সেদিন তিন লাখ টাকা জরিমানা করতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এই নির্দেশনা তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। খাল রক্ষায় সিটি করপোরেশনের তৎপরতা বলতে গত এক বছরে এটুকুই।

রামচন্দ্রপুর খালের বর্তমান অবস্থা। খালের অনেক অংশ ভরাট হয়ে গেছে, আবর্জনার স্তূপ জমেছে। গতকাল দুপুরে। তানভীর আহাম্মেদ

খালের বর্তমান অবস্থার কথা মেয়র আতিকুল ইসলামকে জানানো হলে গত শনিবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে চাই। খাল রক্ষায় এলাকাবাসীকে সম্পৃক্ত করা হবে। আর খালপাড়ের খামারমালিকদের ডেকেছি। তাঁদেরও খালের দায়িত্ব নিতে হবে।’

ঢাকা উত্তর সিটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, খাল খনন ও পরিষ্কার করার জন্য দৈনিক ৪০ হাজার টাকা ভাড়ার বিনিময়ে গত বছর একটি ভাসমান খননযন্ত্র নেওয়া হয়েছিল। এই যন্ত্র দিয়ে প্রতিদিন আট ঘণ্টা কাজ হতো। খননযন্ত্রের জন্য দিনে জ্বালানি তেল (ডিজেল) খরচ হতো ১০০ লিটার। এ ছাড়া খননযন্ত্র চালানোর দুজন অপারেটরের দৈনিক মজুরি ছিল ৩ হাজার টাকা। শুধু খননযন্ত্রের পেছনেই ব্যয় হয়েছিল প্রায় ২২ লাখ টাকা। এর বাইরে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরাও রামচন্দ্রপুর খালের আবর্জনা সরানোর কাজে যুক্ত ছিলেন তখন।

খাল উদ্ধারের পর তা আবার আগের জায়গায় কেন চলে যাচ্ছে, এমন প্রশ্নে ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এস এম শরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে কাজটি করা কঠিন। একবার পরিষ্কার করে দেওয়ার এক সপ্তাহ পরে গিয়ে আবার খালে আবর্জনা পাওয়া যায়। নগরবাসীকেও সচেতন হতে হবে। তিনি বলেন, খাল পরিষ্কার রাখার জন্য সিটি করপোরেশনের নিজস্ব ভাসমান খননযন্ত্র নেই। ঠিকাদারের কাছ থেকে এই যন্ত্র ভাড়া করার কাজটি সময়সাপেক্ষ। কারণ, টেন্ডার আহ্বান করতে হয়। তাই চাইলেও যখন প্রয়োজন ঠিক তখনই কাজটি করা যায় না। তবে ভাসমান খননযন্ত্র কেনার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

রামচন্দ্রপুর খাল মোহাম্মদপুর এলাকার বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই খাল দিয়ে বছিলা গার্ডেন সিটি, চাঁদ উদ্যান, সাতমসজিদ ও চন্দ্রিমা আবাসিক এলাকার বৃষ্টির পানি নিষ্কাশিত হয়।

খালের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ বন্ধ

তিন মাস ধরে ঢাকা উত্তর সিটির সব খালের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ বন্ধ রয়েছে। যে কারণে রামচন্দ্রপুরের পাশাপাশি অন্য খালগুলোতেও বর্জ্যের স্তূপ জমছে। উত্তর সিটির আওতাধীন এলাকায় খাল রয়েছে ২৯টি। এ ছাড়া একটি জলাধারও রয়েছে। রাজধানীর সব খাল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বুঝে নেয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন।

উত্তর সিটির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কাজের আওতা ও পরিধি অনুযায়ী খাল রক্ষায় যে জনবল প্রয়োজন, তা সিটি করপোরেশনের নেই। যে উদ্দেশ্যে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে খালগুলোর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনকে দেওয়া হয়েছে, সেই উদ্দেশ্য কতটা পূরণ করা গেছে, তা রামচন্দ্রপুর খালের বর্তমান অবস্থাই বলে দিচ্ছে।

আরও পড়ুন

বড় বড় কথা ও লোকদেখানো প্রচার চালিয়ে খালের পানিপ্রবাহ ধরে রাখা যায় না বলে জানান নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, খাল রক্ষার জন্য যে ধরনের কারিগরি জনবল ও পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার, তা সিটি করপোরেশনের নেই। যে কারণে খাল খনন ও পরিষ্কার রাখার কাজটি টেকসই হচ্ছে না। এর বড় প্রমাণ রামচন্দ্রপুর খাল।

স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘খালে তরল এবং কঠিন বর্জ্য যাতে না পড়ে এবং খাল যাতে দূষিত না হয়, সে ধরনের পরিকল্পিত ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ সিটি করপোরেশনের নেই। খাল খননের পর দুই পাড়ে মানুষের হাঁটাচলার সুন্দর ব্যবস্থা, বসার ব্যবস্থা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ঘাটলার ব্যবস্থা করে দিতে হয়। তখন মানুষ খালে ময়লা ফেলবে না। কেউ ফেলতে চাইলেও অন্যরা বাধা দেবে। সমন্বিত ও টেকসই পরিকল্পনা ছাড়া অস্থায়ী ভিত্তিতে কিছু একটা করে একেবারে খাল উদ্ধার করে ফেলেছি—এ রকম বক্তৃতা দিলে কোনো কাজ হবে না।’

আরও পড়ুন