ঢাকার প্রথম পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা এখন যেমন

ওয়ারীর লারমিনি স্ট্রিটে এখনো টিকে আছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের নান্দনিক একতলা ও দোতলা বাড়ি। গাছপালাসমেত আড়াই তলা বাড়িটির সামনে প্রশস্ত উঠান, পেছনে রয়েছে ফাঁকা জায়গাছবি: দীপু মালাকার

ঢাকার সব থেকে অভিজাত আবাসিক এলাকা হিসেবে একসময় পরিচিত ছিল ওয়ারী। ওয়ারীতে থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কবি-সাহিত্যিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ একঝাঁক সাংস্কৃতিক কর্মী। সেই সময় ওয়ারীর রাস্তাগুলো ছিল প্রশস্ত। রাস্তা ঘেঁষে ছিল একতলা–দোতলা বাড়ি। বাড়ির দেয়াল পেরোলে আঙিনা। আঙিনায় ফুল, ফল ও সবজির চাষ—এই ছিল ওয়ারীর প্রতিটি বাড়ির সাধারণ চিত্র। চার শ বছর পেরোনো এই ঢাকা শহরের সব থেকে অভিজাত আবাসিক এলাকাটি বর্তমানে তার জৌলুশ হারিয়েছে। কিন্তু ওয়ারীজুড়ে মোগল স্থাপত্যকলার নিদর্শন, দুর্লভ বাগান ও একতলা বাড়ির সাবেকি রূপ এখনো টিকে আছে।

ব্রিটিশ সরকার ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি গঠনের ১৪ বছর পর ১৮৮০ সালে সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসনের কথা ভেবে ৭০১ একর জায়গা অধিগ্রহণ করেন ওয়ারীতে। প্লটের জন্য জমি নির্ধারিত হয় ১ বিঘা। তবে কিছু কিছু প্লটের আয়তন ছিল দুই বিঘা। ওয়ারীর র‍্যানকিন স্ট্রিটের ৩৭ নম্বর বাড়িটি ছিল দুই বিঘা জমির ওপর। ৫ মে সকাল সোয়া ১০টার দিকে বাড়িটির সামনে গিয়ে দেখা যায়, দুই বিঘা আয়তনের প্লটটি এখন দুই মালিকানায় বিভক্ত। দুটি বাড়ির একটির হোল্ডিং নম্বর ৩৭ আরেকটির ৩৭/১।

স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, পাকিস্তান আমলে দুটি বাড়ি মিলে একটি দোতলা বাড়ি ছিল, যা ‘নন্দী ডাক্তারের বাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। এখন নন্দী বাড়ির সামনের অংশ ভেঙে গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল ভবন। সেই ভবনে বাণিজ্যিক কার্যক্রমও চলে। তবে দুই বাড়ির বহুতল ভবনের মাঝে ডা. নন্দীর দোতলা বাড়ির আদি অংশটি এখনো টিকে আছে।

সুমন ধর ৩৭/১ বাড়িটির ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে আছেন। তিনি বলেন, ‘বাড়িটি পাকিস্তান আমলে নন্দী ডাক্তারের বাড়ি নামে পরিচিত ছিল। বাড়ির মালিকের কাছ থেকে শুনেছি। এই দুটি বাড়ি মিলে একটি বাড়ি ছিল। দুই বাড়ির মাঝখানে ওই চুন-সুরকির অংশটি আদি বাড়ির নিদর্শন।’

পাকিস্তান আমলে ওয়ারীর র‍্যানকিন স্ট্রিটের ৩৭ নম্বর দোতলা বাড়িটি বরাদ্দ পান পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্য, কংগ্রেস নেতা, ভবেশ চন্দ্র নন্দী। চিকিৎসক মন্মথ নাথ নন্দী ১৯৫৩ বা ৫৪ সালের দিকে বাড়িটি তাঁর কাছ থেকে কিনে নেন। তিনি সম্পর্কে ভবেশ নন্দীর জ্ঞাতি ভাই ছিলেন। তবে চিকিৎসক মন্মথ নাথ নন্দী বাড়িটিতে ওঠার আগে থেকেই ঢাকার সর্বজনপ্রিয় চিকিৎসক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিতি ছিলেন।

নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর আধুনিক অ্যাপার্টমেন্টও আছে লারমিনি স্ট্রিটে। ১৪ তলা আবাসিক ভবনটির প্রতিটি তলায় রয়েছে ফুল আর অর্কিডের বাগান
ছবি: প্রথম আলো

একজন ডা. নন্দী

পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ঢাকা শহরে ডাক্তাররা ২০ টাকা ভিজিট নিতেন। চিকিৎসক মন্মথ নাথ নন্দী ৫ টাকার বেশি নিতেন না। প্রতিদিন সর্বোচ্চ ২০ জন রোগী দেখতেন।

সেই সময় ঢাকা শহরে এমন বাসিন্দা খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল যে, চিকিৎসক নন্দীর নাম ও ওয়ারীর বাড়িটি চিনতেন না। বলছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা এ আর মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি ১৯৫৫ সাল থেকে ওয়ারীর লারমিনি স্ট্রিটের ২২ নম্বর বাড়িটিতে থাকছেন।

মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, ডাক্তার নন্দী উচ্চ মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তেতাল্লিশের মন্বন্তর, ৫০ সালে ঢাকা শহরের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঠেকাতে ‘সিংহহৃদয়’ এই চিকিৎসকের ভূমিকা ঢাকাবাসীর মুখে মুখে ছিল। আর ষাট-সত্তরের দশকের রুচিশীল, শিক্ষিত লোকেরা বাস করতেন ওয়ারীতে। হেয়ার স্ট্রিটের ২ নম্বর বাড়িটায় শিল্পী কামরুল হাসান, শিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদ ও সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী থাকতেন। র‌্যানকিন স্ট্রিটে থাকতেন চিকিৎসক মন্মথ নাথ নন্দী, অ্যাডভোকেট সবিতা রঞ্জন পাল, রাজনীতিবিদ শুধাংশু শেখর হালদার, বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য প্রমুখ। লারমিনি স্ট্রিটে চল্লিশের দশকে ছিলেন অমর্ত্য সেনরা। ঢাকার প্রথম ও ভারতীয় উপমহাদেশের সাড়াজাগানো পেশাদার ওয়ারী স্পোর্টিং ক্লাবের যাত্রাও শুরু এখান থেকে।

কবি ও সম্পাদক আবুল হাসনাত তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, পঞ্চাশের দশকে চিকিৎসক নন্দীর বাড়িটি সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। নাচ, গান, নাটকের মহড়া চলত। রবীন্দ্র শতবর্ষ উদ্‌যাপন পরিষদের সভা ও সাংস্কৃতিক দলের মহড়া তাঁর দুই বিঘা আয়তনের দোতলা বাড়িকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতো। এ ছাড়া ওয়ারীর প্রতিটি গৃহে বৃক্ষ ও বাগানের পরিচর্যা ছিল। সকাল-বিকেল খেলাধুলা ও সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি সংস্কৃতি চর্চার রেওয়াজ ছিল প্রতিটি বাড়ির নিত্যদিনের চিত্র।

বর্তমানের ওয়ারী

বর্তমানে ওয়ারী এলাকাটি মূলত টিপু সুলতান রোড (উত্তর অংশ) র‍্যানকিন স্ট্রিট, লারমিনি স্ট্রিট, নবাব স্ট্রিট, হেয়ার স্ট্রিট, ওয়্যার স্ট্রিট, যুগীনগর লেন, জয়কালী মন্দির রোড নিয়ে গঠিত। এলাকাটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন।

এই ওয়ার্ডের অন্যান্য এলাকার তুলনায় ওয়ারী এলাকাটি এখনো খানিকটা ভিন্ন প্রকৃতির। রাস্তাঘাট প্রশস্ত। তবে এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রশস্ত সড়কগুলো বেশ অপরিচ্ছন্ন। সড়ক দখল করে চলছে রকমারি ব্যবসা। আর আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক কার্যক্রম বর্তমানে ওয়ারীর স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে।

ওয়ারীতে ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত সিলভারডেল প্রিপারেটরি অ্যান্ড গার্লস হাইস্কুলের সামনে মানুষের স্বাভাবিক চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার কারণে। প্রতিটি সড়কে আছে বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন। একটি ভবন থেকে আরেকটি ভবনের অবস্থান নির্দিষ্ট দূরত্বে। এর মধ্যে র‍্যানকিন স্ট্রিট ও লারমিনি স্ট্রিটে টিকে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী দৃষ্টিনন্দন বেশ কয়েকটি পুরোনো বাড়ি। লারমিনি স্ট্রিটে ঐতিহ্যের সঙ্গে সংগতি রেখে আধুনিক স্থাপত্যকলায় নির্মিত প্রকাণ্ড অ্যাপার্টমেন্ট হাউজও চোখে পড়ে।

১৬০০ সালে প্রতিষ্ঠিত ওয়ারীর খ্রিষ্টান কবরস্থানে ওলন্দাজ ও আর্মেনীয় নাগরিকদের সমাধিসৌধ
ছবি: প্রথম আলো

র‍্যানকিন স্ট্রিট পেরিয়ে লারমিনি স্ট্রিট

র‌্যানকিন স্ট্রিটের ৩৮ নম্বর বাড়িটি স্থানীয়দের কাছে ধল্লার জমিদার বাড়ি নামে পরিচিত। ৫ মে ধল্লা হাউস ঘুরে দেখা যায়, ভবনটি এখনো আদি অবস্থায় টিকে আছে। লাল ইটের তৈরি ইউরোপীয় ও ইন্দো-সারাসেনিক স্থাপত্য মিশেলে তৈরি সে বাড়ি। খোদাই করা বারান্দা, লোহার গ্রিলের নিখুঁত কারুকাজ জেল্লা হারালেও এখনো টিকে আছে। কাঠের সিঁড়ির হাতলগুলোতে দারুণ কারুকাজ করা, বেশ খানিকটা ক্ষয়ে গেছে; পাটাতনগুলো পাথরের।

স্থানীয় এক প্রবীণ ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘পাকিস্তান আমল থেকে ভবনটি নানাভাবে অযত্নে-অবহেলায় ব্যবহৃত হচ্ছে। নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর এ রকম একটি ঐতিহাসিক ভবন চোখের সামনে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, এটা দেখে খুব কষ্ট হয়।’

র‍্যানকিন স্ট্রিটজুড়েই আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চোখে পড়েছে। বেশ কয়েকটি প্লটে বহুতল ভবনজুড়ে গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। র‍্যানকিন স্ট্রিটের ৪২ নম্বর প্লটে গড়ে উঠেছে বহুতল এ কে ফেমাস টাওয়ার। পুরো ভবনজুড়ে আড়ং, বিশ্ব রঙসহ নামীদামি ব্র্যান্ডের দোকান রয়েছে।

র‍্যানকিন স্ট্রিটের পাশের সড়ক লারমিনি স্ট্রিটও বহুতল বাণিজ্যিক ভবনে ছেয়ে গেছে। তবে ঐতিহ্যের সঙ্গে সংগতি রেখে আধুনিক স্থাপত্যকলায় নির্মিত নান্দনিক অ্যাপার্টমেন্টের দেখা মিলেছে লারমিনিতে। স্ট্রিটের ২৪ নম্বর প্লটটিতে ম্যাক্স বুর্জই সামিট নামে একটি ১৪ তলা দালান নির্মিত হয়েছে। অ্যাপার্টমেন্টটির ব্যবস্থাপক সাজ্জাদ হোসেন জানান, মোগল স্থাপত্যের সঙ্গে সংগতি রেখে এক বিঘা দুই কাঠা আয়তনের প্লটটিতে অ্যাপার্টমেন্টটি নির্মিত হয়েছে। দেয়ালের গাঁথুনিতে ব্যবহার করা হয়েছে সিরামিক ইট। অ্যাপার্টমেন্টের ৫২টি ফ্ল্যাটেই যাতে পর্যাপ্ত আলো–বাতাস প্রবেশ করে স্থপতিরা সেই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টের ডিজাইন ঠিক করেছেন।

অ্যাপার্টমেন্টটির নিচতলায় রয়েছে পানির প্রবাহ। চারপাশের ফাঁকা জায়গায় লাগানো হয়েছে দৃষ্টিনন্দন অর্কিড, ফুলের গাছ। ফলে প্রচণ্ড গরমেও অ্যাপার্টমেন্টজুড়ে একটা শীতল পরিবেশ থাকে। ম্যাক্স বুর্জই সামিটে রয়েছে শিশুদের জন্য খেলার জায়গা, ব্যাডমিন্টন কোর্ট, স্কাই ভিউ সুইমিং পুল, বারবিকিউ এরিয়া, পার্টি সেন্টারসহ আধুনিক আবাসিকতার সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। ১৪ তলা অ্যাপার্টমেন্টটির প্রতি তলায় গড়ে তোলা হয়েছে ফুল আর অর্কিডের বাগান, যা প্রতিটি তলাকে করেছে মায়াময়।

লারমিনি স্ট্রিটের সড়কগুলো এখনো বেশ প্রশস্ত। সড়কের পাশে আজও টিকে আছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলের নান্দনিক একতলা ও দোতলা বাড়ি। এ রকম একটি বাড়ির নাম ‘মুনতাশশা’। ২১ লারমিনি স্ট্রিটের আড়াইতলা উচ্চতার বাড়িটিতে ১৯৮৬ সাল থেকে থাকছেন অবসরপ্রাপ্ত বিমা কর্মকর্তা মুনির আহমেদ। আম-কাঁঠালগাছ ঘেরা এক বিঘা বাড়িটির উঠানে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের এই বাড়িটির একটি অংশ নির্মিত হয়েছে ব্রিটিশ আমলে, আরেকটি অংশ পাকিস্তান আমলে। ওয়ারী আবাসিক এলাকা ৯০ দশক পর্যন্ত ছিল নিরিবিলি। আমি গর্ব অনুভব করি, আমি যে স্ট্রিটে থাকি, সেই স্ট্রিটের ১৪ নম্বর বাড়িটিতে চল্লিশের দশক পর্যন্ত অমর্ত্য সেনের পরিবার থাকতেন।’

১৮৮৪ সাল থেকে পরের পাঁচ বছরেই পরিকল্পিত এক নগরী হিসেবে গড়ে উঠেছিল ওয়ারী। তৎকালীন ঢাকার ইংরেজ কর্মকর্তাদের নামানুসারে ওয়ারীর স্ট্রিটগুলোর নাম রাখা হয় র‌্যানকিন স্ট্রিট, লারমিনি স্ট্রিট, ওয়্যার স্ট্রিট, হেয়ার স্ট্রিট।

ইতিহাস গবেষক হাশেম সূফী বলেন, ‘ওয়ারীর নাম যে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট ওয়্যারের নাম থেকে আসেনি, এটা আমি নিশ্চিত। আপনি এখনো ওয়ারীর পুরোনো বাড়িগুলোর ফলকে দেখবেন লেখা আছে “উয়ারী”। এই উয়ারী হয়তো উয়ারী বটেশ্বর থেকে এসেছে। আর ওয়ারী একটি ফার্সি শব্দ, যার অর্থ বড় তাঁবু। মোগল আমলে এখানে সেনানিবাস ছিল। বড় বড় তাঁবুতেই মোগল সেনারা বসবাস করত। নামটি সেখান থেকেও এসে থাকতে পারে।’

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত বলধা গার্ডেনের অবস্থানও ওয়ারীতে
ছবি: প্রথম আলো

মোগল স্থাপত্যকলার নিদর্শন

ওয়ারী যে অবিভক্ত বাংলার নগর আবাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন তার টুকরা টুকরা ছবি ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে এলাকাজুড়ে। ওয়ারীতে রয়েছে ঢাকার সবচেয়ে পুরোনো খ্রিষ্টান কবরস্থান।

১৬০০ সালে প্রতিষ্ঠিত কবরস্থানটিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মী থেকে শুরু করে ওলন্দাজ, আর্মেনিয়ান নাগরিকদের কবর দেখা গেছে। আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ইংরেজ সৈনিকদের গণকবর। সেই অর্থে এটিকে ওয়ার–সিমেট্রিও বলা যায়।

৫ মে দুপুরে কবরস্থান ঘুরে দেখা যায়, কিছু সমাধির বয়সকাল ইউরোপিয়ানদের বাংলা দখলেরও পূর্বে। সমাধি ফলকগুলোর এপিটাফ মুছে গেছে। সন-তারিখ খালি চোখে বোঝা যায় না। সমাধিক্ষেত্রে শায়িত আছেন পোগোজ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা জমিদার নিকোলাস পোগোজ, মিটফোর্ড হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট, আলেকজান্ডার সিম্পসন।

সিপাহি বিদ্রোহের স্মৃতিও বহন করছে এই সমাধিক্ষেত্র। সিপাহি বিদ্রোহে নিহত দুই সৈনিকের স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। এর একটি ফলকের লেখা এখনো স্পষ্ট, ‘হেনরি স্মিথ, ২৩ নভেম্বর, ১৮৫৭’।

বিশপ রেজিনাল্ড হেবারের লেখা ন্যারেটিভ অব আ জার্নি থ্রো দ্য আপার প্রভিন্স অব ইন্ডিয়া, ফ্রম কলকাতা টু বোম্বে (১৮২৪-১৮২৫) বইয়ে সমাধিক্ষেত্রটি সম্পর্কে তাঁর ভাষ্য, সমাধিক্ষেত্রটি মোগল আমলে নির্মিত এটি বোঝা যায়। কিছু সমাধিক্ষেত্র আটকোনা গথিক মিনার আকৃতিতে নির্মিত। মোগল স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন কারুকার্যখচিত গম্বুজ ও আট জানালাবিশিষ্ট কিছু সমাধিক্ষেত্র। আর দেখতে, আপার্থিব সুন্দর।

ছায়া সুনিবিড় বলধা গার্ডেন

খ্রিষ্টান কবরস্থানের পাশ ঘেঁষে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত বলধা গার্ডেনের অবস্থান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সঞ্চয়িতা কাব্যগ্রন্থের বিখ্যাত কবিতা ‘ক্যামেলিয়া’ বলধা গার্ডেনে বসে লিখেছিলেন। ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর দ্বিতীয় ঢাকা সফরে বলধা গার্ডেন ঘুরে দেখেছেন। জয় হাউসে থেকেছেন এক রাত।

বলধা গার্ডেন প্রতিষ্ঠা করেন গাজীপুরের বলধার জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী। তিনি ১৯০৬ সালে বলধা গার্ডেনে দুর্লভ উদ্ভিদ সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। তা শেষ হয় ১৯৩৬ সালে এসে। বিশ্বের ৫২টি দেশ থেকে দুর্লভ ও দৃষ্টিনন্দন ফুল ও ফলের চারা-বীজ সংগ্রহ করে গড়ে তোলা হয় বাগানটি। উদ্ভিদ সংগ্রহের এই মহতী উদ্যোগের তিনি নাম দেন ‘PSYCHE’ বা ‘সাইকী’। এর পর নতুন করে জায়গা কিনে উদ্যানের সম্প্রসারণ করেন নবাব স্ট্রিটের উত্তর পাশজুড়ে। সেই অংশের নাম দেন ‘সিবিলী’। ‘সাইকী’ ‘সিবিলী’ মিলিয়ে উদ্যানের মোট আয়তন ৩ দশমিক ৩৮ একর।

৫ মে দুপুর দেড়টায় সিবিলী অংশ ঘুরে দেখা যায়, বাইরের খরতাপের ছিটেফোঁটাও নেই বলধা গার্ডেনের উত্তরাংশে। মায়াঘেরা ‘শঙ্খনাদ’ পুকুরে নেমেছে দীঘল ছায়ার ঝুম দুপুর। পুকুরকে কেন্দ্র করে রয়েছে আমাজান লিলি, শাপলাজাতীয় জলজ উদ্ভিদ, ক্যাকটাস ও অর্কিডের দুর্লভ সংগ্রহ। শঙ্খনাদের পূর্ব পাড়ে রয়েছে ‘সূর্ঘঘড়ি’। দেশের সর্বপ্রথম ও একমাত্র নিখুঁত সময় দেওয়ার প্রাকৃতিক সূর্যঘড়ি! আর গার্ডেনের অশোক, নাগলিঙ্গম, সোনালুজাতীয় বড় বড় ফুলগাছগুলো পুরো বাগানকে দুপুর মায়ায় বেঁধে ফেলেছে।

ব্রজহরি স্ট্রিট থেকে বলছি…

বলধা গার্ডেনের দক্ষিণাংশ ও ওয়ারী খ্রিষ্টান কবরস্থানের পাশ ঘেঁষে ব্রজহরি সাহা স্ট্রিট অবস্থিত। ব্রজহরি সাহা স্ট্রিটের স্থায়ী বাসিন্দা রইসউদ্দিন। খ্রিষ্টান কবরস্থানের মুখোমুখি একটি ‘ফ্লেক্সি লোডের’ ব্যবসা পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের আদি বাড়ি বিক্রমপুর। বালুচরা ইউনিয়নের চাঁদচর গ্রাম। বাবা তরুণ বয়সে ব্যবসার উদ্দেশ্যে পরিবারসহ ওয়ারী চলে আসেন। ব্রজহরি স্ট্রিটে আমার জন্ম ১৯৭৯ সালে। আমাদের শৈশব-কৈশোরেও আমরা ওয়ারীর আভিজাত্য উপভোগ করেছি। পুরো ওয়ারী ছিল ছায়াময়। একতলা-দোতলা বাড়িগুলোর আম–কাঁঠালের ছায়া স্ট্রিটে এসে পড়ত। ছায়াপথে সাইকেল চালিয়ে ওয়ারী উচ্চবিদ্যালয়ে যেতাম। ব্রজহরি স্ট্রিট থেকে নবাব স্ট্রিট। নবাব স্ট্রিট থেকে র‍্যানকিন স্ট্রিট। নন্দী ডাক্তারের পাশের বাড়ি ধলা হাউসের সামনে জমত আড্ডা। লারমিনি স্ট্রিট, ওয়্যার স্ট্রিট, হেয়ার স্ট্রিট ঘুরে জয়কালী মন্দির—কৈশোর পর্যন্ত এই ছিল বিচরণ। আমাদের চেনা ওয়ারী একটু একটু করে বদলে গেছে। নব্বইয়ের ওয়ারীকে এখন চিনতে খুব কষ্ট হয়।’