কড়া রোদ উপেক্ষা করে নূর মোহাম্মদ সেলফোনে মেয়ে নুসরাত জাহানের ছবি তুলছিলেন খুব যত্ন করে। নুসরাতের মা তানিয়া পারভিনও ছিলেন পাশে দাঁড়িয়ে। ছবিটি অবশ্য পত্রিকায় ছাপা হবে না। তাতে অসুবিধা নেই। নুসরাতের বাবা বলছিলেন, ছবি ফেসবুকে পোস্ট দেবেন। মেয়ের এই আনন্দের দিনে তাঁরাও শেরেবাংলা নগর থেকে এসেছেন অংশ নিতে।
এই আনন্দের মেলা বসে রাজধানীর অদূরে আশুলিয়ার বিনোদনকেন্দ্র ফ্যান্টাসি কিংডমে। গতকাল সোমবার সকাল নয়টা থেকে শুরু হয় শিখো-প্রথম আলো জিপিএ-৫ সংবর্ধনার অনুষ্ঠান। সেখানেই প্রথম আলোর প্রথম পাতার আদলে তৈরি ফটো তোলার জায়গায় মেয়ের ছবি তুলছিলেন তিনি।
‘স্বপ্ন দেখো জীবন গড়ো’ স্লোগান নিয়ে দেশজুড়ে নবীন প্রাণের এই বিপুল উৎসব এবার শুরু হয় ১১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের ফয়স লেক থেকে। এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এবার যারা জিপিএ-৫ পেয়েছে, তাদের সংবর্ধনার উৎসব আয়োজন করে প্রথম আলো। সঙ্গে আছে শিক্ষার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম শিখো। পাওয়ার্ড বাই বিকাশ। সহযোগিতায় কনকর্ড গ্রুপ, ফ্রেশ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ ক্যাম্পাস, এটিএন বাংলা ও প্রথম আলো বন্ধুসভা। ঢাকার আয়োজনে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল লিমিটেড।
ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার কৃতী শিক্ষার্থীদের দুই দিনের সংবর্ধনার অনুষ্ঠান শুরু হয় গতকাল থেকে। প্রথম দিনে প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেয়। সকাল নয়টায় শিক্ষার্থীদের জন্য ফ্যান্টাসি কিংডমের ফটক খুলে দেওয়া হয়।
ফ্যান্টাসি কিংডমের ভেতরটা সাজানো হয় বর্ণাঢ্যভাবে। সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর স্টল ছিল সারি সারি।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাঁদের অনেক অভিভাবক বিশেষত মা-বাবা এবং ছোট ভাইবোনেরাও নিজ ব্যবস্থাপনায় এই আয়োজনে অংশ নেন। ফলে পারিবারিক সম্প্রীতির আবহও মিশেছিল অনুষ্ঠানজুড়ে। রচিত হয় সম্প্রীতি আর সাফল্যের যুগলবন্দী দৃশ্য।
দেশের ভবিষ্যতের নির্মাতা তরুণ প্রজন্মকে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সাফল্যের স্বীকৃতি এবং অনুপ্রেরণা দিতে প্রথম আলো এই আয়োজন করে আসছে ১৯৯৯ সাল থাকে। তখন অবশ্য শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাইয়ের জন্য জিপিএ পদ্ধতি চালু হয়নি। এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় যারা সম্মিলিত মেধাতালিকায় শীর্ষে থাকত, তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হতো।
সকাল থেকেই ফ্যান্টাসি কিংডমে শিক্ষার্থীরা মেতে ওঠে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, সেলফি তোলা আর রাইডগুলোতে ওঠার আনন্দে। শনিরআখড়া থেকে চার বন্ধু শাহরিয়ার হোসেন, জিদান ইসলাম, ইমতিয়াজ মাহমুদ ও আজম মোস্তফা গণপরিবহন ‘মৌমিতা’ কোম্পানির বাসে করে সকাল সাতটায় রওনা দিয়ে বেলা ১১টায় এসেছে অনুষ্ঠানকেন্দ্রে। তারা সবাই শামসুল হক খান স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী। রোলারকোস্টারে উঠেছিল তারা। দারুণ সময় কাটছে বলে জানাল। এমন গল্প অনেক।
মঞ্চে মনমাতানো অনুষ্ঠান
দুপুরের খাবারের পরে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সুমনা শারমীনের সঞ্চালনায় জাতীয় সংগীত দিয়ে শুরু হয় সংবর্ধনা মঞ্চের আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তিনি শিক্ষার্থীদের মুখস্থ, মিথ্যা ও মাদকের প্রতি ‘না’ বলার অঙ্গীকার করান। কথার ফাঁকে গানে গানে এগিয়ে চলে অনুষ্ঠান। আফরান মৃধা গেয়ে শোনান, ‘সাদা সাদা কালা কালা’ এবং ‘ফুল ফুটেছে’ গান দুটি।
স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য নওজিয়া ইয়াসমিন শিক্ষার্থীদের বলেন, প্রত্যেক মানুষই আলাদা। সবারই বিশেষ কিছু প্রতিভা রয়েছে। সেই প্রতিভাকে বিকশিত করতে হবে। সে জন্য তিনি তাদের বড় করে স্বপ্ন দেখতে ও সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য পরিশ্রম করতে বলেন।
ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ শাখা ক্যাম্পাসের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক দাতো মো. সালেহ বিন জাফর বলেন, সফল হতে হলে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে।
বিকাশ লিমিটেডের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মীর নওবত আলী শিক্ষার্থীদের বলেন, জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষায় তোমরা সাফল্য পেয়েছ। এখন লক্ষ্য নির্ধারণ করে অবিচলভাবে সেদিকে এগিয়ে যেতে হবে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা মো. বখতিয়ার হোসেন মা–বাবা ও দেশকে ভালোবাসার উপদেশ দেন। কনকর্ড গ্রুপের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা অনুপ কুমার সরকার শিক্ষার্থীদের ভালো ছাত্র হওয়ার পাশাপাশি ভালো মানুষ হয়ে ওঠার কথা বলেন।
এই পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের আবার গান শোনাতে আসেন শিল্পী পান্থ কানাই ও অনিমেষ রায়। তারা কোক স্টুডিওর জনপ্রিয় গান ‘নাসেক নাসেক’ ও ‘দোল দোল দুলুনি’ গানগুলো গেয়ে শোনান।
এরপর আলোচনা পর্বে শিখোর প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও শাহীর চৌধুরী তাঁর দলের সদস্যদের নিয়ে মঞ্চে আসেন। তিনি বলেন, এসএসসিতে সফল হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের সামনে এখন অনেক বড় সম্ভাবনার দুয়ার খুলে গেছে। সামনে আছে এইচএসসি, তারপর আরও অনেক দূরে যেতে হবে। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন এটিএন বাংলার অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান তাশিক আহমেদ ও প্রথম আলো বন্ধুসভার জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের নির্বাহী সভাপতি মৌসুমি মৌ।
প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক কবি সাজ্জাদ শরিফ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, সাফল্য ও সার্থকতা দুটি আলাদা বিষয়। তোমরা সফল হয়েছ। এখন সার্থকতা লাভ করতে হবে। সেই সার্থকতা আসবে পরিবার, সমাজ ও দেশের প্রতি দায়িত্ব পালনের ভেতর দিয়ে।
এরপর গানে গানে সবাইকে মাতিয়ে তোলেন জলের গানের শিল্পীরা। তাঁরা গেয়েছেন ‘এমন যদি হতো’, ‘রঙের গান’, ‘পরের জায়গা পরের জমি’ ও ‘বকুল ফুল’। মঞ্চে আসেন তরুণ প্রজন্মের জনপ্রিয় অভিনয়তারকা সিয়াম আহমেদ। শিক্ষার্থীরা বিপুল করতালি ও হর্ষধ্বনিতে তাঁকে অভিনন্দন জানান। একসময় তিনিও শিক্ষার্থী হিসেবে প্রথম আলোর এই জিপিএ-৫ সংবর্ধনায় অংশ নিয়েছেন বলে জানান। সিয়াম শিল্পী তাহসান খানের ‘আলো আলো’ এবং ‘দূরে তুমি দাঁড়িয়ে’ গান দুটির খানিকটা করে গেয়ে শোনান। সেই গানের রেশ নিয়েই উৎসবের মঞ্চ থেকে ঘরে ফিরেছে সফল শিক্ষার্থীরা।
আজকের অনুষ্ঠান
আজ মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আলোচনা পর্বে অংশ নেবেন ইউল্যাবের উপাচার্য ইমরান রহমান, প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কথাশিল্পী আনিসুল হক, শিখোর প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও শাহীর চৌধুরী। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবেন চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, অভিনয়শিল্পী চঞ্চল চৌধুরী, সংগীতশিল্পী প্রীতম হাসান, জেফার রহমান ও জলের গানের শিল্পীরা।