‘বাসে উঠলে মনে হয় দেশে যাত্রীদের দেখার কেউ নাই’

বাসের জন্য যাত্রীদের অপেক্ষাছবি: সামছুর রহমান

রাজধানীর গাবতলী থেকে নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড পর্যন্ত দূরত্ব ২২ কিলোমিটার। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর সরকারনির্ধারিত হিসাবে এ দূরত্বের ভাড়া আসে ৫৫ টাকা। কিন্তু এ পথে চলাচলকারী লাব্বাইক এবং এম এম লাভলী পরিবহনে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৭০ টাকা। এ বাসগুলোয় এবারের জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির আগে থেকেই যাত্রীপ্রতি ৫০ টাকা ভাড়া আদায় করা হতো।

 আজ রোববার সকাল থেকে রাজধানীর আটটি পথে চলাচলকারী বাসের চালক, চালকের সহকারী ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাসভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হলেও এখনো দূরত্বভিত্তিক তালিকা (চার্ট) তৈরি হয়নি। এ কারণে বাসমালিকদের বলে দেওয়া ভাড়াই আদায় করা হচ্ছে। সর্বনিম্ন ভাড়া ১৫ টাকার কম নেওয়া হচ্ছে না। কোনো কোনা বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা।

সরেজমিন দেখা যায়, সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস হলেও সকাল থেকে রাজধানীর সড়কে বাসের সংখ্যা অন্যান্য দিনের তুলনায় কম। ভাড়া নিয়ে জটিলতার শঙ্কায় অনেক মালিক বাস নামাননি। যাঁরা নামিয়েছেন, তাঁরা নিজেদের ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছেন। ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে চালকের সহকারীদের বাগ্‌বিতণ্ডাও হচ্ছে। যাত্রীরা বলছেন, প্রতিবার সরকার ভাড়া ঠিক করে দেয়, কিন্তু তা মানা হয় না। এবারও যাত্রীদের ‘গলা কাটা’ হচ্ছে।

সরকার গত শুক্রবার রাতে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করে। মূল্যবৃদ্ধির প্রথম ধাক্কাটি এসেছে পরিবহন খাতে। গতকাল শনিবার সরকার পরিবহনমালিকদের সঙ্গে বৈঠকে বাসের নতুন ভাড়া নির্ধারণ করে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সাধারণ মানুষের যাতায়াতের প্রধান বাহন বাসের ভাড়া নগরে বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ।

রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ নগর পরিবহনে প্রতি কিলোমিটার ৩৫ পয়সা ভাড়া বেড়ে এখন ২ টাকা ৫০ পয়সা হয়েছে। এর আগে প্রতি কিলোমিটার ভাড়া ছিল ২ টাকা ১৫ পয়সা। মিনিবাসে বর্তমানে ২ টাকা ০৫ পয়সা। এটি বাড়িয়ে করা হয়েছে ২ টাকা ৪০ পয়সা। বাস-মিনিবাসে সর্বনিম্ন ভাড়া আগের মতোই যথাক্রমে ১০ ও ৮ টাকা।

দাঁড়িয়ে যাত্রী নিচ্ছে বাসগুলো
ছবি: প্রথম আলো

কুড়িল থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার। নতুন হার অনুযায়ী এ দূরত্বের ভাড়া আসে ৪০ টাকা। এ পথে চলাচলকারী স্মার্ট উইনার পরিবহনের আজ সকাল থেকে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৫০ টাকা করে। যাত্রীপ্রতি সরকারনির্ধারিত ভাড়া চেয়ে ১০ টাকা করে বেশি নেওয়া হচ্ছে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাসভাড়া নির্ধারণের বিষয়টা কমেডির মতো হয়ে গেছে। সরকার একটা বলে দেয়, বাসে উঠলে তার প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া দিতে হয়। টাকা তো শেষ পর্যন্ত আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পকেট থেকেই বের হয়।’

সরকারনির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত টাকা নিয়েও বাসশ্রমিকেরা সন্তুষ্ট নন। স্মার্ট উইনার পরিবহনের চালকের সহকারী মিলন মিয়া বলেন, ‘একটা ট্রিপ দিয়ে দেখতে আসছিলাম তেলের খরচ ওঠে কি না। অবস্থা ভালো নয়। এখন কুড়িল ফিরে গাড়ি বন্ধ করে রাখব। আজকে আর চালাব না।’

মৌমিতা পরিবহনের বাসে সাভার থেকে আজিমপুর পর্যন্ত ভাড়া আগে ছিল ৫০ টাকা। এ পথের দূরত্ব ২৩ কিলোমিটার। নতুন হার অনুযায়ী ভাড়া আসে ৫৮ টাকা। আজ সকাল থেকে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৬৫ টাকা। আজিমপুর থেকে গাবতলী পর্যন্ত আগে ভাড়া নেওয়া হতো ২০ টাকা, এখন নেওয়া হচ্ছে ২৫ টাকা।

কল্যাণপুর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। সরকারনির্ধারিত হিসাবে এ দূরত্বের ভাড়া আসে সাড়ে ১২ টাকা। কিন্তু এই পথে চলাচলকারী প্রতিটি বাসে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ২০ টাকা। এ বাসগুলোয় এবারের জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির আগে থেকেই যাত্রীপ্রতি ১৫ টাকা ভাড়া আদায় করা হতো।

বাসে হুড়মুড়িয়ে উঠছেন যাত্রীরা
ছবি: সামছুর রহমান

অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে চালকের সহকারীর সঙ্গে তর্ক করছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. তরিকুল। তাঁর যুক্তি, আগের ১৫ টাকাই বেশি ছিল। এখন আরও ৫ টাকা জোর করে নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘ভাই, বাসে উঠলে এত কষ্ট লাগে, মনে হয়, দেশে যাত্রীদের দেখার কেউ নাই। বাসের লোকজন জোর খাটায়ে যত খুশি ভাড়া নিতে পারে।’
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রাজধানীতে চলাচলকারী বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা। তবে আজ সকাল থেকে কোনো বাসেই সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা নিতে দেখা যায়নি। বিভিন্ন পথে চলাচলকারী লাব্বাইক, এম এম লাভলী, মেট্রো সার্ভিস, বিকাশ পরিবহন, ভিআইপি পরিবহন, স্মার্ট উইনার, সেফটি এন্টারপ্রাইজে সর্বনিম্ন ভাড়া ১৫ থেকে ২০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। তবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়ার ক্ষেত্রে ১০ টাকা নেওয়া হচ্ছে।

সড়কে নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবারই বাসের ভাড়া বৃদ্ধির বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হয়, তা মালিক-শ্রমিকেরা মানেন না। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে সরকারের উদ্যোগ নেই। এটি পরিবহনমালিকেরাই নিয়ন্ত্রণ করেন। যাত্রীদের জিম্মি করে বছরের পর বছর এই বাড়তি ভাড়া নেওয়া দুঃখজনক।