এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘর ঐতিহ্য-সংস্কৃতি সংরক্ষণের চেষ্টা করছে

বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘরের পঞ্চম প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অতিথিরা। ঢাকা, ২২ অক্টোবর
ছবি: প্রথম আলো

ঐতিহ্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে জাদুঘর। পুরান ঢাকার নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রয়েছে। কালের বিবর্তনে নানা কারণে তা হারিয়ে যাচ্ছে। এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘর তা সংরক্ষণ করার চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘরের পঞ্চম প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে রোববার রাজধানীর নিমতলীতে সোসাইটি মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে ‘পুরান ঢাকার সমাজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য: বিবর্তনের আলেখ্য’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হাফিজা খাতুন। তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির ভাইস প্রেসিডেন্ট। প্রবন্ধের সহলেখক গবেষক বিবি হাবিবা শম্পা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

হাফিজা খাতুন বলেন, পুরান ঢাকার নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রয়েছে। কালের বিবর্তনে রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন গোষ্ঠীর ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। পুরান ঢাকার অপরিকল্পিত উন্নয়ন হচ্ছে। অপরিকল্পিত উন্নয়নে যেকোনো দুর্ঘটনার উদ্বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে। তিনি পুরান ঢাকার বিভিন্ন ঐতিহ্য, রীতিনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণার পরিসর বাড়ানোর বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন।

হাফিজা খাতুন ও বিবি হাবিবা শম্পা পুরান ঢাকায় বড় হয়েছেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত লোকজনদের একটি বড় অংশই পুরান ঢাকায় থাকেন, পুরান ঢাকাকে ভালোবাসেন বা পুরান ঢাকা নিয়ে গবেষণা করছেন। তাই হাফিজা খাতুন প্রবন্ধ উপস্থাপনের ফাঁকে ফাঁকে নিজের অভিজ্ঞতা বলছিলেন, মিলনায়তনের অতিথিদের মধ্যেও অনেকে মাথা নেড়ে প্রবন্ধের উল্লেখিত বিভিন্ন বিষয়ে সায় দিচ্ছিলেন।

হাফিজা খাতুন তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের প্রথম পদচারী–সেতু ব্রিটিশ আমলে তৈরি হয়েছিল পুরান ঢাকার বাংলা বাজার মোড়ে। ফুল বিক্রিসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসার প্রচলন হয় পুরান ঢাকায়। বিয়েতে কনের বাবাকে সাহায্য করতে স্বজনেরা মেয়ের ঘর সাজিয়ে দিতেন। হলুদের অনুষ্ঠানে নারীরা ঢোল বাজিয়ে গানবাজনা করতেন। মহিষের শিঙের তৈরি জিনিস ‘কাঙ্গী সাজ’ বিয়েতে উপহার দেওয়া হতো। ঈদ, পূজা উদ্‌যাপনের পাশাপাশি পুঁথি, কিচ্ছাপাঠ, বিয়ের গান, ছাদ পেটানোর গান, নৌকাবাইচ, শাকরাইন উৎসব, মেলা, যাত্রাপালা, চড়কপূজাসহ বিভিন্ন আয়োজন ছিল।

প্রবন্ধে আরও উল্লেখ করা হয়, লালবাগের মোমিন মোটর কোম্পানি ঢাকায় প্রথম পাবলিক বাস সার্ভিস চালু করে। ক্রাউন থিয়েটারে ১৮৯৮ সালে প্রথম বায়োস্কোপ দেখানো হয়। খেলাধুলায় ফরাশগঞ্জ ও লালবাগ স্পোর্টিং ক্লাবগুলোর অবদান ছিল অনেক। বাকরখানিসহ বিভিন্ন খাবার পুরান ঢাকার নিজস্ব ঐতিহ্য।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, এশিয়াটিক সোসাইটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ঐতিহ্য জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই জাদুঘরে যাঁরা বিভিন্ন নিদর্শন দান করেছেন, তাঁরা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সরকারের বিভিন্ন সহায়তা অব্যাহত থাকবে উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী জাদুঘরের উন্নয়নে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। অনুষ্ঠান শেষে প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলমসহ অন্যান্য অতিথি জাদুঘরটি ঘুরে দেখেন।

এশিয়াটিক সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন। তাতে সোসাইটির জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার অন্যতম কেন্দ্র ঐতিহ্য জাদুঘরের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তিনি জানান, ইংরেজ কোম্পানি শাসনের সূচনাপর্বে কোম্পানির কলকাতা কাউন্সিলের নির্দেশে ঢাকায় কর্মরত ইংরেজ মিত্র নায়েব নাজিম জসরত খানের বাসস্থান হিসেবে ১৭৬৫-৬৬ সালে নিমতলী এলাকায় প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়। এটি নিমতলী কুঠি বা নিমতলী প্যালেস নামে পরিচিত। ১৮২২ সালে সরকারিভাবে নায়েব নাজিমদের ক্ষমতার বিলুপ্তি ঘটে। তবে ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত এ প্রাসাদ নাজিমদের উত্তরাধিকারীদের সরকারি বাসভবন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে প্রাসাদটি প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। তবে পশ্চিম প্রবেশদ্বার দেউড়ি ভবনটি অক্ষত থাকে। এটিই নিমতলী দেউড়ি নামে পরিচিত। ১৯৫২ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি অব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে দেউড়ির একটি কক্ষে এর অফিস স্থাপিত হয়। সোসাইটি বর্তমান ভবনে স্থানান্তরিত হলে ১৯৮৩ সাল থেকে দেউড়িটি পরিত্যক্ত হয়। ২০১১ সালে নিমতলী দেউড়ির সংস্কারকাজ করা হয়। এ ভবনে এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘর যাত্রা শুরু করে ২০১৮ সালের ১১ অক্টোবর। এখানে সতেরো থেকে উনিশ শতকের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই জাদুঘরের বিভিন্ন নিদর্শন দান করেছেন ঢাকার বনেদি পরিবারের সদস্য ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ইমেরিটাস অধ্যাপক খন্দকার বজলুল হক। তিনি বলেন, এ ধরনের একটি জাদুঘর ঐতিহ্য সংরক্ষণে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তিনি সবাইকে জাদুঘরে আসার আহ্বান জানান।