কারখানার ঝাড়ুদার থেকে হয়েছেন মহাজন, কিন্তু এখন ব্যবসাই বিলুপ্তির পথে
‘আমি যহন আইছি, তহন এই ঘর ঝাড়ু দিতাম। এখন মাহাজন (মহাজন) হইছি। তবে এহন এই ব্যবসার করুণ অবস্থা।’
কথাগুলো বলছিলেন লিটন শেখ। তিনি চশমার কাচের লেন্স প্রস্তুত ও পাওয়ার বসানোর কারখানা ভাই ভাই গ্রাইন্ডিংয়ের স্বত্বাধিকারী। রাজধানীর পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীর ঘি পট্টিতে কারখানাটি অবস্থিত।
পাটুয়াটুলীর এমন একটি কারখানায় ১৯৯০ সালে ঝাড়ুদার হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন লিটন শেখ। তখন এই ব্যবসার ‘স্বর্ণযুগ’ চলছিল। পরবর্তী সময়ে তিনি নিজেই একটি কারখানার মালিক হন। কিন্তু এখন এই ব্যবসা বিলুপ্তির পথে।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলেন, একসময় চশমার কাচের লেন্স প্রস্তুত ও পাওয়ার বসানোর অন্তত ২২টি কারখানা ছিল পাটুয়াটুলী এলাকায়। কিন্তু এখন মাত্র দুটি কারখানা টিকে আছে। কারণ, এখন বাজারে চশমার ফাইবারের লেন্সের দাপট। তাই ক্রেতারা কাচের লেন্স কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন না।
যেভাবে পাওয়ার বসে
ভাই ভাই গ্রাইন্ডিংয়ের কর্মচারীরা জানান, ভারত থেকে আমদানি করা হয় কাচের গ্লাস। চশমা বিক্রির বিভিন্ন দোকান থেকে তাঁদের কাছে ফরমাশ দেওয়া হয়। মেমোতে থাকে চশমার কাচের আকৃতি ও পাওয়ারের বিস্তারিত বিবরণ। সে অনুযায়ী, কোন ধরনের কাচ চশমায় ব্যবহার করা হবে, তা বাছাই করা হয়।
পাওয়ার অনুযায়ী ছোট একটি চুল্লিতে দুটি কাচ জোড়া লাগানো হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় বেশ কিছু রাসায়নিক দ্রব্য। চুল্লিতে দেওয়ার আগে কাচে আঠা লাগিয়ে তা ডাইসের সঙ্গে সেঁটে দেওয়া হয়।
পরবর্তী ধাপে কার্বোডাম নামের একটি যন্ত্রে কাচ পাতলা করা হয়। মিহিং নামের একটি যন্ত্রে কাচ প্রাথমিকভাবে সমান করা হয়। ফাইন নামের যন্ত্রে পানি, বালু ও একধরনের রাসায়নিক দিয়ে কাচ পুরোপুরি মসৃণ করা হয়।
এরপর ডাইস ও স্কেলের মাধ্যমে কাচের পাওয়ার ঠিক করা হয়। পুরো প্রক্রিয়ায় সময় লাগে ১৫ থেকে ২০ মিনিট। এভাবে চশমার কাঠামোয় (ফ্রেম) যুক্ত করার উপযোগী হয়ে যায় কাচ। প্রতি জোড়া কাচ প্রস্তুত করে পাওয়ার বসাতে খরচ পড়ে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা।
ফরমাশে ধস
পাটুয়াটুলী লেনে পাশাপাশি দুটি ভবন। দুই ভবনের মাঝখানের অন্ধকার গলি ধরে এগিয়ে গেলে চোখে পড়ে ছোট্ট একটি উন্মুক্ত জায়গা।
জায়গাটির বাঁ পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে উঠে গেছে একটি ভবনের সিঁড়ি। সিঁড়িটি রেখে সামনে এগিয়ে গেলে আরেকটি সরু গলি। গলিটিতে অবস্থিত আট ফুট বাই বারো ফুটের ঘুপচি ঘরটি ফরহাদ গ্রাইন্ডিংয়ের।
গত মঙ্গলবার এই ঘরে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙাচোরা লোনাধরা দেয়ালের তিন পাশে জ্বলছে তিনটি টিউবলাইট। কিন্তু তাতেও ঘরের অন্ধকার যেন কাটছে না।
ছোট্ট প্রবেশমুখের পাশটি বাদ দিলে ঘরের বাকি তিন পাশে চারকোনা তিনটি যন্ত্রের সামনে কাজ করছিলেন তিনজন লোক। একজন গোল গোল কাচে লাল রঙের একধরনের তরল মাখিয়ে তা একটি যন্ত্রে বসিয়ে দিচ্ছিলেন। অন্যজন দুটি পাত্রে দুই ধরনের তরলে কাচ ডুবিয়ে রাখছিলেন।
অচেনা মানুষ দেখে একজন এগিয়ে এলেন। জানতে চাইলেন, চশমার কাচের অর্ডার দিতে এসেছেন কি না। উত্তরে না বলায় তাঁর ভ্রু কিছুটা কুঞ্চিত হলো। তবে পরিচয় দিতেই পরক্ষণে হাসিমুখে ভেতরে যেতে ইশারা করলেন তিনি।
ছোট্ট ঘরের ভেতরে যন্ত্রের তীব্র শব্দে কিছুই শোনা যায় না। এর মধ্যেই লোকটি জানালেন তাঁর নাম শহিদুল ইসলাম। ফরহাদ গ্রাইন্ডিং নামের কারখানার মালিক তিনি। এই পেশায় আছেন প্রায় চার দশক।
শহিদুল ইসলাম বলেন, ফাইবারের লেন্সের দাপটে তাঁদের ব্যবসা এখন বিলুপ্তির পথে। এখন তেমন কেউ চশমায় কাচের লেন্স লাগাতে চান না। একসময় তাঁর কারখানায় ২৫ জন কাজ করতেন। দিনে প্রায় ১০০ থেকে ১২০ জোড়া লেন্স তৈরি করতেন তাঁরা। তবে এই সংখ্যা কমে এখন ১০ থেকে ১৫ জোড়ায় নেমে এসেছে। আর কর্মচারীর সংখ্যা নেমেছে দুজনে।
‘এই বয়সে আবার কী করমু’
শহিদুল ইসলামের কাছ থেকেই লিটন শেখের ভাই ভাই গ্রাইন্ডিং কারখানাটির খবর পাওয়া যায়। পাটুয়াটুলীর ঘি পট্টি এলাকার ৬ নম্বর বাড়ির তিনতলায় কারখানাটির অবস্থান। নামে কারখানা হলেই এটি আসলে আলো-বাতাসহীন ঘুপচি একটি ঘর।
লিটন শেখ জানান, তিনি ৩৫ বছর ধরে এই পেশায় আছেন। তাঁর কারখানায় আগে ১১ জন কাজ করতেন। এখন কাজ করছেন দুজন। এখন দিনে ১০ থেকে ১২ জোড়ার বেশি অর্ডার আসে না।
ব্যবসা বিলুপ্তির পথে। তাহলে এখন এই ব্যবসা নিয়ে কী ভাবছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে লিটন শেখ বলেন, ‘ব্যবসার আর কিছুই নাই। বাইচ্যা থাকার জন্য করতাছি। এখন এই বয়সে নতুন জায়গায় (ব্যবসা) যাইয়া আবার কী করমু? এখন তো সবাই অটো চালায়। তার চেয়ে একটা সম্মানের জায়গায় আছি, সবাই ওস্তাদ কয়। ওখানে গেলে (অটো চালানো) থাপ্পড় দিবো, মাইর খাওন লাগবো। তার চেয়ে এইটার মধ্যেই থাকি।’