সুর-সংগীতে জন্মদিনের শুভেচ্ছায় সিক্ত নবতিপূর্ণা সন্জীদা খাতুন
‘গানের শিক্ষা, সাধনা আর প্রসারের কাজে নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদন করতে পারলে সে আনন্দ জীবনের সব চাওয়া-পাওয়াকে ছাড়িয়ে যায়। সেই যে ছেলেবেলায় সবার মঙ্গলসাধনের জন্য ইচ্ছা হয়েছিল, সেই ইচ্ছা থেকে শিশুদের জন্য, দেশের জন্য, বাঙালি জাতির জন্য কাজ করে জীবনটা অর্থবহ হয়েছে বলে মনে করি।’ ৯০ বছর পূর্ণ করে জন্মদিনের উৎসবে নিজের অনুভবের কথা এভাবেই ব্যক্ত করলেন বাঙালি জাতিসত্তা ও সংস্কৃতি এবং মানবতার সাধক, বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সন্জীদা খাতুন।
৪ এপ্রিল সন্জীদা খাতুনের ৯০তম জন্মবার্ষিকী। দিনটি উদ্যাপনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র ছায়ানট। আজ মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর ধানমন্ডির ছায়ানট সংস্কৃতি ভবনে এ অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশনা, নির্বাহী সভাপতির বক্তব্য এবং মণিপুরী দলের সম্মেলক নৃত্য পরিবেশনার পর ছিল নবতিপূর্ণা সন্জীদা খাতুনের কথন।
নানা ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে একটি দীর্ঘ জীবন দেখেছেন বিশিষ্ট এই সংগীতসাধক। নিজের শৈশবে মানুষের প্রতি মায়া তৈরি হওয়ার গল্পটি বললেন উপস্থিত শ্রোতাদের। সেই সঙ্গে উঠে এল, শেষ বিকেলে দক্ষিণের বারান্দায় পাটি পেতে তাঁর বড়দির গান শেখার সময়টা মাত্র পাঁচ বছর বয়সে সন্জীদা খাতুনকে কতটা প্রভাবিত করেছিল।
সে বয়সে নিজের ভালো লাগা ‘এসো এসো হে তৃষ্ণার জল, কলকল্ ছলছল্/ ভেদ করো কঠিনের ক্রূর বক্ষতল কলকল্ ছলছল্’ গানটি গেয়ে শোনালেন সন্জীদা খাতুন। তখন তাঁর হাতে জড়ানো ছিল বেলি ফুলের মালা। বললেন ছায়ানটের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার গল্প। জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের কার্যক্রমের কথাও উঠে এল।
রমনার বটমূলে বোমা হামলার ঘটনা কতখানি ব্যথিত করেছিল, জানাতে গিয়ে বললেন, ‘সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সুফল নিয়ে আমাদের আত্মসন্তোষ বিরাট ধাক্কা খেয়েছিল। বোঝা গেল, পূর্ণাঙ্গ মানুষ গড়ে তুলবার উপযোগী শিক্ষার অভাব অতি প্রকট।’
সন্জীদা খাতুনের ৯০তম জন্মবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি সারওয়ার আলী বললেন, ‘সর্বজন যেন বাঙালি জাতিসত্ত্বাকে হৃদয়ে ধারণ করে বিশ্বমানব হয়ে ওঠে, তার সাধনা করে চলেছেন মুক্তচিন্তা ও সংগীতের পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা সন্জীদা খাতুন। বয়সের কারণে কিছুটা অসমর্থ হলেও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও চিন্তাধারার ক্ষেত্রে তিনি এখনো সচল ও সক্রিয়। আর তা আমাদের সবার জন্য সুসংবাদ।’
এ সময় তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে কয়েক দশক ধরে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-লোকসংগীতের বাণী ও সুরের বিকৃতির ধারাবাহিকতার প্রতি সতর্ক হওয়ার প্রসঙ্গ।
সন্জীদা খাতুনের জন্মবার্ষিকী উৎসবে ছায়ানট আয়োজন করেছে রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেনের গান, লালনগীতির।
ধীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা’ গানটি পরিবেশন করে জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানালেন শিল্পী ইফ্ফাত আরা দেওয়ান। ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ’ গেয়ে শোনালেন ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক শিল্পী লাইসা আহমেদ লিসা।
শাহ আবদুল করিমের ‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান’ গান পরিবেশন করল ছায়ানটের ছোটদের দল। চন্দনা মজুমদার, শারমিন সাথী ইসলাম ও ফারহানা আক্তার ছাড়াও কয়েকজন শিল্পী গান পরিবেশন করলেন সন্জীদা খাতুনের ৯০তম জন্মবার্ষিকী উৎসবে।
আয়োজন শুরু হয়েছিল রাগ বৃন্দাবনী সারংয়ে শিল্পী অভিজিৎ কুণ্ডুর শাস্ত্রীয় সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে।
সন্জীদা খাতুনের বিভিন্ন সময়ের ছবি ব্যবহার করে ধূসর কালো একটি নান্দনিক শুভেচ্ছাপত্রের অপর পাশে শিল্পীর ছবি এঁকেছেন মমিনুল হক। ফুল, আলপনা, কলাপাতা দিয়ে ছায়ানট প্রাঙ্গণ সাজিয়ে, মঙ্গল কামনায় জ্বালানো হয়েছিল মাটির প্রদীপ।
সন্জীদা খাতুনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ছিল এক উদার, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবারে। ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল তাঁর জন্ম। বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন চিন্তা, সৃজন, বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রের অগ্রগণ্য ব্যক্তি। বাবাকে ঘিরে তৎকালীন প্রণিধানযোগ্য শিল্পী, সাহিত্যিকদের সমাগম ছিল তাঁদের বাড়িতে। সন্জীদা খাতুনের মানস গঠনের উন্মেষ হয়েছিল এখান থেকেই।