‘হায়েনায় ছাড়ে না, আমিও ছাড়ি না’

ব্যথা ভুলিয়ে রাখতে সাইফকে মুঠোফোনে ভিডিও দেখাচ্ছেন মা-বাবা
ছবি: মানসুরা হোসাইন

হাসপাতালের বিছানায় দুই বছর তিন মাস বয়সী সাইফের বাঁ হাতে ক্যানুলা লাগানো। আর ডান হাত যতটুকু আছে, তার পুরোটাই ব্যান্ডেজে মোড়ানো। কারণ, হায়েনা তার এই হাতের কনুই থেকে নিচ পর্যন্ত কামড়ে নিয়ে গেছে। ঘটনার ভয়াবহতা বুঝতে না পারলেও শিশুটির মুখটিতে ক্লান্তি ও ব্যথার ছাপ স্পষ্ট। ব্যথা ভুলিয়ে রাখতে হাসপাতালের বিছানায় মা, বাবা বা নানির কোলে বসিয়ে তাকে মুঠোফোনে দেখানো হচ্ছে ভিডিও। মুঠোফোনে মগ্ন থাকলেও মাঝেমধ্যে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠছে সে। আর মুঠোফোন সরিয়ে নিতে চাইলেই করছে চিৎকার।

আজ শনিবার দুপুরে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) গিয়ে দেখা যায় এ দৃশ্য। সেখানে কথা হয় শিশুটির মা, বাবা, নানাসহ অন্যদের সঙ্গে।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সাইফের নানা শরিফুল ইসলাম বললেন, ‘হাত তো চিড়িয়াখানার হায়েনা খাইয়্যা ফালাইছে। হায়েনায় ছাড়ে না, আমিও ছাড়ি না। পরে হাতটা ছিঁড়া হায়েনার খাঁচার ভিতরে চইলা যায়।’

গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর মিরপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানার হায়েনার খাঁচার কাছে চলে গিয়েছিল সাইফ। তার ছোট্ট হাতের আঙুল খাঁচার নেটের ভেতর দিয়ে ঢুকতেই কামড়ে ধরে হায়েনা। এরপর হাত বাঁচাতে চলে টানাটানি। একপর্যায়ে হাতটি কনুই থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

সাইফের পরিবারের অভিযোগ, খাঁচার বাইরে নিরাপদ দূরত্ব রেখে দর্শনার্থীদের দাঁড়ানোর যে নিরাপত্তাবেষ্টনী আছে, গতকাল ঘটনার সময় সেই বেষ্টনীর দরজা খোলা ছিল। আর সেই সুযোগেই হায়েনাকে কাছ থেকে দেখতে দরজা দিয়ে খাঁচার কাছে চলে গিয়েছিল সাইফ। তবে এতে নিজেদের অসতর্কতার বিষয়টিও অস্বীকার করেনি তারা।

সাভারের জিরানীতে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন সাইফের বাবা সুমন মিয়া। সুমন মিয়া-শিউলি বেগম দম্পতির একমাত্র সন্তান সাইফ। সে জীবনের প্রথমবারের মতো নানাসহ অন্যদের সঙ্গে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে এসেছিল।

গাজীপুরে থাকেন সাইফের নানা শরিফুল ইসলাম। পেশায় রংমিস্ত্রি। মেয়ে বাবার বাড়ি বেড়াতে যাওয়ায় শরিফুল মেয়েসহ পরিবারের সাত সদস্যকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে এসেছিলেন বৃহস্পতিবার। তিনি বললেন, সাইফ তার মায়ের কোল থেকে কখন নেমে গিয়েছিল, তা কেউ খেয়াল করেননি।

শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘শুধু নানা বইল্যা একটা চিৎকার শুনি। তারপর তো আমরা হাত ধইরা টানাটানি করতে থাকি। হায়েনার যে কত শক্তি, সেদিন টের পাইছি। দোষ আমাদের ছিল, তা অস্বীকার করমু না। তবে দরজাটা খোলা না থাকলে এই ঘটনা ঘটত না। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা এই ঘটনার দায় নিব। কিন্তু নাতির হাত তো আর ফিরা পামু না।’

নিরাপত্তাবেষ্টনীর দরজা কেন খোলা ছিল, এ প্রসঙ্গে জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, এই দরজা সাধারণত স্টাফরা যখন কোনো প্রাণীর খাঁচায় ঢোকেন, তখন খোলা হয়। দরজা খোলা রাখার কথা নয়। এই বিষয়ে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের গঠিত দুটি তদন্ত চলছে। তদন্তেই আসল ঘটনা বের হয়ে আসবে। তদন্তের আগে এ বিষয়ে কিছু মন্তব্য করা ঠিক হবে না।

রফিকুল ইসলাম তালুকদার জানালেন, হায়েনাটির বয়স হয়েছে ১৪ বছর। হায়েনা হিংস্র প্রাণী। চিড়িয়াখানায় বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর পৌনে ১২টার মধ্যে হায়েনার খাঁচায় খাবার দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার যখন ঘটনাটি ঘটে, তখন পর্যন্ত হায়েনাকে খাবার দেওয়া হয়নি। শুধু ক্ষুধার্ত ছিল বলে হায়েনা কামড় দিয়েছে এমন নয়, হায়েনা এমনিতেই হিংস্র প্রাণী।

যাতে কোনো দর্শক কোনোভাবেই নিরাপত্তাবেষ্টনী ডিঙাতে না পারেন, সে জন্য বেষ্টনীগুলো, বিশেষ করে হিংস্র প্রাণী যেগুলোতে থাকে, সেগুলোর বেষ্টনী পর্যায়ক্রমে ৬ ফুট উঁচু করা এবং যেগুলো মেরামতের প্রয়োজন, তা মেরামত করা হচ্ছে বলে জানান চিড়িয়াখানার পরিচালক।

সাইফের বাবা সুমন মিয়া খবর পেয়ে ছুটে আসেন ছেলের কাছে। তিনি বললেন, ‘চিড়িয়াখানার দরজাটা খোলা না থাকলে বাচ্চাটার আজ এ দশা হইত না। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে চিকিৎসার জন্য ৩০ হাজার টাকা দিছে। বলছে, এরপর যা লাগব তা-ও দিব। আমি চাই, নিজেদের ভুলে বা চিড়িয়াখানার গাফিলতির জন্য আর কোনো বাচ্চার যাতে এমন অবস্থা না হয়।’

সুমন মিয়া তাঁর সন্তানের পাশে সবাই যাতে সহায়তায় এগিয়ে আসেন, সে আহ্বান জানিয়েছেন। বললেন, হাতটা অকেজো হয়ে গেল, ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তো রয়েই গেল।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) পরিচালক আবদুল গনি মোল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, শিশুটিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় বেলা তিনটার দিকে। এখন সে ভালো আছে। তার চিকিৎসায় পাঁচ সদস্যের একটি বোর্ড গঠন করা হয়েছে।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসক মানস দাস জানালেন, বৃহস্পতিবার শিশুটিকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর খুব দ্রুত আঘাতের জায়গা পরিষ্কার করে সেলাই করে দেওয়া হয়েছিল। আজ ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছিল, সেলাইয়ের জায়গা ভালো আছে। মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে নিয়ে শিশুটিকে জলাতঙ্কের টিকা দেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে শিশুটি এখন পর্যন্ত ভালো আছে।

বৃহস্পতিবার চিড়িয়াখানার এ ঘটনা খতিয়ে দেখতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকেও আলাদা তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা।

আরও পড়ুন