ময়লার কাজ পেতে মরিয়া কাউন্সিলররা

ঢাকা উত্তরে ওয়ার্ড ৫৪টি। এর মধ্যে ৩৫টি ওয়ার্ডের বিপরীতে দেওয়া দরপত্রে কাউন্সিলরদের সম্পৃক্ততা আছে।

ঢাকা উত্তর সিটিতে বর্জ্য সংগ্রহের ঠিকাদারির কাজ পেতে দরপত্র সংগ্রহ করেছেন আনোয়ার হোসেন। তিনি সিটি করপোরেশনের একজন মশককর্মী (ক্রু)। তবে দরপত্র তিনি নিজের জন্য কেনেননি। নিয়েছেন এল রহমান হালিম নামের এক ব্যক্তির জন্য। ভাটারা থানা আওয়ামী লীগের সদস্য হালিম মূলত কাউন্সিলর ইসহাক মিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম এনঅ্যান্ডএস এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ পাইয়ে দিতে কাউন্সিলর প্রত্যয়নও দিয়েছেন।

অথচ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ওই ওয়ার্ডে বাসাবাড়ির বর্জ্য সংগ্রহের কাজ করেও কাউন্সিলরের প্রত্যয়ন পাননি দুটি ভ্যান সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের মালিক জাহিদ হাসান ও তাজ উদ্দিন। তাজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাউন্সিলরের কাছে গিয়েছিলাম। বলেছেন, কাজটা আমিই নিয়ে আসব।’

ঘটনাটি ঢাকা উত্তর সিটির ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের। এ বিষয়ে ওয়ার্ডটির কাউন্সিলর ইসাহাক মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন সিস্টেম করেছে। এখন কাজটা আইনা সবাইকে বণ্টন করে দিতে হবে। বিশ্বস্ত লোকের মাধ্যমে কাজ না আনলে তো, পরে বণ্টন করা যাবে না।’

‘সে তো অনেক আগে থেকেই (২০০২ সালে কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই) ময়লার কাজ করত। এখন ওয়ার্ডের ছেলেপেলেদের দিয়ে কাজটি দিচ্ছে।’ আইন অনুযায়ী কাউন্সিলরের স্বজনেরা ঠিকাদার হতে পারেন না—জানানো হলে তিনি বলেন, ‘এটা আমার জানা নেই।’
মুরাদ হোসেন, কাউন্সিলর

ঢাকা উত্তর সিটির ৫৪টি ওয়ার্ড রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম আলোর হিসাবে ৩৫টি ওয়ার্ডের বিপরীতে দেওয়া দরপত্রে কাউন্সিলরদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। ময়লার কাজ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে মরিয়া কাউন্সিলররা কোনো ওয়ার্ডে সরাসরি নিজের নামেই দরপত্র জমা দিয়েছেন। কেউ দরপত্র জমা দিয়েছেন স্ত্রী, ভাগনে-ভাতিজা, মেয়ের জামাতা কিংবা স্বজনের নামে। কোনো কোনো ওয়ার্ডের আবেদনকারী ঠিকাদার আবার কাউন্সিলরের বন্ধু, ব্যক্তিগত সহকারী, রাজনৈতিক অনুসারী কিংবা ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। কাউন্সিলরদের প্রভাবে ঢাকা উত্তর সিটির ৩২টি ওয়ার্ডে মাত্র একটি করে দরপত্র জমা হয়েছে। অথচ আবেদনপত্র বিক্রি হয়েছিল আড়াই শতাধিক।

আরও পড়ুন

কাউন্সিলর নিজেই ঠিকাদার

দরপত্র জমা দিয়েছেন সংরক্ষিত ওয়ার্ডের একজন নারী কাউন্সিলর। সংরক্ষিত-১১ নম্বর ওয়ার্ডের (সাধারণ ওয়ার্ড ২৯, ৩০ ও ৩২) ওই কাউন্সিলর হচ্ছেন শাহিন আক্তার। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম দুস্থ মানুষের কথা (ভিওডি)।

২০২১ সালের আগে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা উত্তর সিটির ২৯ নম্বর ওয়ার্ডে বর্জ্য সংগ্রহের কাজ করত। সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সলিম উল্লাহ ওরফে সলু কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। দায়িত্ব নেওয়ার চার মাসের মধ্যে বড় ভাই এম এ ওয়াদুদকে দিয়ে শাহিন আক্তারের ময়লার কাজটি তিনি দখলে নিয়েছিলেন। তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নাম স্বপ্ন মানবিক কল্যাণ সংস্থা (স্বমকস)।

এ বিষয়ে কাউন্সিলর শাহিন আক্তারের বক্তব্য জানতে সিটি করপোরেশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার ফোন করা হয়েছিল। কিন্তু সংযোগটি বন্ধ পাওয়া গেছে। তাই বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

আইনের ব্যত্যয় করে কোনো ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হবে না। যদি প্রমাণিত হয়, কাউন্সিলরদের কারও ভাই, কারও আত্মীয় তাহলে অবশ্যই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মেয়র আতিকুল ইসলাম, ঢাকা উত্তর সিটির

কাউন্সিলরের স্ত্রীও ঠিকাদার

ময়লার কাজ পেতে স্ত্রীর নামে দরপত্র জমা দিয়েছেন ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মুরাদ হোসেন। এ ওয়ার্ড থেকে মাত্র একটি দরপত্র জমা পড়েছে। দরপত্র জমা দেওয়া প্রতিষ্ঠানটি হচ্ছে টুগেদার এন্টারপ্রাইজ। এর মালিক শিরিন রুখসানা।

কাউন্সিলর কার্যালয়ের সূত্রে জানা গেছে, শিরিন রুখসানা কাউন্সিলর মুরাদ হোসেনের স্ত্রী। তবে তিনিও (শিরিন) অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক একজন নারী কাউন্সিলর। বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কেন্দ্রীয় কমিটির ১ম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।

এ বিষয়ে কাউন্সিলর মুরাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সে তো অনেক আগে থেকেই (২০০২ সালে কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই) ময়লার কাজ করত। এখন ওয়ার্ডের ছেলেপেলেদের দিয়ে কাজটি দিচ্ছে।’ আইন অনুযায়ী কাউন্সিলরের স্বজনেরা ঠিকাদার হতে পারেন না—জানানো হলে তিনি বলেন, ‘এটা আমার জানা নেই।’

আরও পড়ুন

আছেন ভাগনে-ভাতিজারাও

২০ নম্বর ওয়ার্ডে দরপত্র জমা দিয়েছেন মো. সাদ্দাম। তিনি কাউন্সিলর মো. নাছিরের আপন ভাতিজা (বড় ভাইয়ের ছেলে)। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম মেসার্স এমআরএইচ ইন্টারন্যাশনাল। তবে ময়লার যাবতীয় কাজ কাউন্সিলরের স্ত্রী লতা নাছিরই দেখভাল করেন বলে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা জানান।

৩০ নম্বর ওয়ার্ডে দরপত্র জমা দিয়েছেন মো. সুমন। ওয়ার্ডটিতে বর্জ্য সংগ্রহের কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকেরা বলছেন, সুমন কাউন্সিলর আবুল কাশেমের আপন চাচাতো বোনের ছেলে। ওই ওয়ার্ড থেকে আরও দুটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দিলেও তাদের কাউকে প্রত্যয়ন দেননি কাউন্সিলর। একইভাবে ৫২ নম্বর ওয়ার্ডে দরপত্র জমা দিয়েছেন কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিনের আপন চাচাতো ভাই রিপন উদ্দিন।

বন্ধুদের দিয়ে ঠিকাদারি

একসময় কাপড় সেলাইয়ে দরজির কাজ (টেইলর) করতেন কামারপাড়ার বাসিন্দা লিটন সিকদার। স্থানীয়রা তাঁকে দরজি লিটন নামে চিনতেন। ভাগ্য খুলে যায় বন্ধু জাহাঙ্গীর হোসেন (যুবরাজ) কাউন্সিলর নির্বাচিত হলে। দরজির কাজ ছেড়ে লিটনও সঙ্গ দেন কাউন্সিলের। একপর্যায়ে ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডে ১০ বছর ধরে বর্জ্য সংগ্রহের কাজ করা পরিবেশ বন্ধু ক্লিনিং সার্ভিসকে হটিয়ে ময়লার কাজ দখল নেন লিটন সিকদার।

একইভাবে ময়লার কাজের জন্য দরপত্র জমা দিয়েছেন ২৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মোনয়ার হাসান। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম এসএইচ এন্টারপ্রাইজ। ওয়ার্ডটিতে মাত্র একটি দরপত্র জমা হয়েছে।

৩৩ নম্বর ওয়ার্ডেও দরপত্র জমা দিয়েছেন কাউন্সিলর আসিফ আহমেদের বন্ধু মাহবুবুর রহমান (রনি)। অভিযোগ আছে, ভ্যান সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলো সঙ্গে এককালীন ও মাসিক চাঁদা নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় বন্ধুকে দিয়ে দরপত্র জমা দিয়েছেন কাউন্সিলর।

কাউন্সিলরের ঘনিষ্ঠরা

ঢাকা উত্তর সিটির ৫ নম্বর ওয়ার্ডে মাত্র একটি দরপত্র জমা পড়েছে। সেটা কাউন্সিলর আব্দুর রউফের ছোট ভাই এস এম মান্নানের (কচি) সহকারী নুর-এ-আলম লেনিনের। এস এম মান্নান ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। আর লেনিন মান্নানের যাবতীয় ঠিকাদারির কাজ দেখাশোনা করেন। এ ছাড়া তিনি ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক উপদপ্তর সম্পাদক।

২৮ নম্বরে দরপত্র জমা দিয়েছে কাউন্সিলর ফোরকান হোসেনের ঘনিষ্ঠ আবদুর রব। তিনি এক সময় ওই ওয়ার্ডের ভ্যান সার্ভিস প্রতিষ্ঠান এ টু জেড মিডিয়া অ্যান্ড সোশ্যাল সার্ভিস সেন্টারের ভ্যানচালক ছিলেন। পরে তাঁকে দিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের কাজটি দখলে নিয়েছিলেন কাউন্সিলর ফোরকানের ছোট ভাই ও শেরেবাংলা নগর থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আসাদুজ্জামান। এ ছাড়া ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হুমায়ুন রশীদের ঘনিষ্ঠ অনুসারী ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শিখন রায়ও দরপত্র জমা দিয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, কাউন্সিলরেরা বর্জ্য সংগ্রহের ঠিকাদারিতে আগ্রহী হয়ে ওঠার কারণ এখানে বিপুল টাকা আয়ের সুযোগ রয়েছে। একেকটি বাসা থেকে এখন ময়লা সংগ্রহের জন্য মাসে সর্বনিম্ন ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ৪০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। আর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া হয় আরও বেশি।

২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, রাজধানীতে ৪৫০ কোটি টাকার ময়লা-বাণিজ্য হচ্ছে। তখন নির্ধারিত ফি ছিল ৩০ টাকা। সেটা মানা হতো না। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এবার ঠিকাদারির ক্ষেত্রে পুরোনো ৩৬টি ওয়ার্ডে সর্বোচ্চ ফি ১০০ টাকা ও নতুন ১৮টি ওয়ার্ডে ৩০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। যদিও তা মানা হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

আইনে যা আছে

স্থানীয় সরকার আইন, ২০০৯ (সিটি করপোরেশন)-এর ধারা ৯ এ ‘মেয়র ও কাউন্সিলরদের যোগ্যতা ও অযোগ্যতায় (২)–এর (জ)–তে বলা আছে, ‘মেয়র বা কাউন্সিলরের পরিবারের কোনো সদস্য সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনের কার্যসম্পাদনের বা মালামাল সরবরাহের জন্য ঠিকাদার হয় বা এর জন্য নিযুক্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হন বা সিটি করপোরেশনের কোনো বিষয়ে তার কোনো প্রকার আর্থিক স্বার্থ থাকে বা সরকার কর্তৃক অত্যাবশ্যক কোনো পণ্যের ডিলার হন, তাহলে মেয়র বা কাউন্সিলর পদে থাকবার যোগ্য হবেন না। ’

ময়লার ঠিকাদারি নিয়ে কাউন্সিলরদের এমন কার্যক্রমের বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আইনের ব্যত্যয় করে কোনো ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হবে না। যদি প্রমাণিত হয়, কাউন্সিলরদের কারও ভাই, কারও আত্মীয় তাহলে অবশ্যই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঠিকাদার নিয়োগের উদ্দেশ্যই হচ্ছে শহর পরিষ্কার রাখা এবং বর্জ্যের কাজ নিয়ে ঠিকাদারকে জবাবদিহির আওতায় আনা। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই বর্জ্যের কাজে শৃঙ্খলা আনতে হবে।

মেয়র আরও বলেন, ‘আমিও অনেক অভিযোগ পাচ্ছি। সার্বিক বিষয় গুরুত্বসহকারে পর্যবেক্ষণ করছি। সবকিছু যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। প্রয়োজনে মেয়রের ক্ষমতা প্রয়োগ করে দরপত্র প্রক্রিয়া বাতিল করা হবে।’