নামেই প্রবীণ হাসপাতাল

হাসপাতালে অন্যান্য বয়সী রোগী থাকলেও প্রবীণ রোগী কম। হাসপাতালটিতে আইসিইউসহ প্রবীণদের জন্য জরুরি অনেক কিছুই নেই।

দেশে প্রবীণের সংখ্যা বাড়লেও ১৯৬০ সালে যাত্রা শুরু করা প্রবীণ হাসপাতালটি এখনো প্রবীণবান্ধব হাসপাতালে পরিণত হতে পারেনি
ছবি প্রথম আলো

রাজধানীর ৬০ ফিট এলাকার বাসিন্দা বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সাবেক পরিচালক মনোয়ারা বেগমের বয়স এখন ৬৭ বছর। ছোটখাটো শারীরিক সমস্যায় অন্য হাসপাতালে না গিয়ে তিনি বাসার কাছেই আগারগাঁওয়ের প্রবীণ হাসপাতালে চিকিৎসক দেখান। ২ অক্টোবর তিনি হাসপাতালটিতে এসেছিলেন মাড়ির একটি দাঁত ভেঙে গেছে বলে। প্রথম আলোকে তিনি বললেন, এখানে তো আর তেমন জটিল কোনো রোগের সমাধান পাওয়া যায় না।

৩০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে (অন্য রোগীদের জন্য টিকিটের দাম ৫০ টাকা) চিকিৎসক দেখিয়েছেন মনোয়ারা বেগম। ওই চিকিৎসক তাঁকে বলেছেন, এখানে অস্ত্রোপচার করা সম্ভব নয়। বাইরের কোনো হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তাঁকে পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক।  

ওই দিন হাসপাতাল ঘুরে মনোয়ারা বেগমের মতো প্রবীণ রোগীর দেখা তেমন পাওয়া গেল না। তবে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ হাসপাতালটির বহির্বিভাগে চিকিৎসক দেখাতে এসেছেন। অর্থাৎ নামে প্রবীণ হাসপাতাল হলেও এখানে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে সব বয়সী নারী-পুরুষকে। বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের (বাইগাম) মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে এই প্রবীণ হাসপাতাল।

প্রবীণদের চিকিৎসায় ইউরোলজি, নিউরোলজি, কার্ডিওলজি অর্থাৎ যে বিভাগগুলো জরুরি, তা এ হাসপাতালে নেই। এগুলো না হলে হাসপাতালটিকে প্রবীণবান্ধব হাসপাতাল বলা যাবে না।
আবু আলতাফ হোসেন, পরিচালক, প্রবীণ হাসপাতাল

জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার। তাঁরা মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০১১ সালের জনশুমারিতে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৪৭।

দেশে প্রবীণের সংখ্যা বাড়লেও ১৯৬০ সালে যাত্রা শুরু করা প্রবীণ হাসপাতালটি এখনো প্রবীণবান্ধব হাসপাতালে পরিণত হতে পারেনি। অনেকে জানেও না যে প্রবীণদের জন্য এ ধরনের একটি হাসপাতাল আছে।

প্রবীণ হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা খুবই কম
ছবি: মানসুরা হোসাইন

যেভাবে শুরু পথচলা

জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা ২০১৩ অনুযায়ী, ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী ব্যক্তিরা প্রবীণ। এই প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ কে এম আবদুল ওয়াহেদ রাজধানীর ধানমন্ডিতে তাঁর বাসভবনে ১৯৬০ সালে বাইগাম গড়ে তুলেছিলেন। পরে সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হতে শুরু করে। ১৯৯৮ সালে ৫০ শয্যার হাসপাতাল চালু হয়। বর্তমানে প্রবীণ ভবনটি চারতলা। এ ভবনেই বাইগামের কমিটির নির্বাচিত সদস্য ও সংঘের অন্য কর্মীরাও বসেন।

১৯৮৫ সালে সংঘের কার্যালয় আগারগাঁওয়ে নেওয়া হয়। তখন সরকারের পক্ষ থেকে এক একর জমি বরাদ্দ দিয়ে একতলা একটি ভবন করে দেওয়া হয়। ১৯৯৩-৯৪ সালে প্রবীণদের স্বাস্থ্য ও আবাসনসেবা সম্প্রসারণে সরকার সংঘকে ৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়।

সংঘের বর্তমান মহাসচিব যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, সরকার জমি বরাদ্দ দিলেও এ জমি এখন পর্যন্ত সংঘের নামে নিবন্ধন করা সম্ভব হয়নি। নিবন্ধন করতে এখন খরচ লাগবে ১৪ কোটি টাকা, যা দেওয়ার সামর্থ্য সংঘের নেই।

তাই প্রধানমন্ত্রী বরাবর আবেদন করা হয়েছে, যাতে প্রবীণদের নামমাত্র মূল্যে জমিটি নিবন্ধনের সুযোগ দেওয়া হয়। আর ৫০ শয্যার হাসপাতালের আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের জন্যও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন করা হয়েছে।

প্রবীণ রোগী কম, সুবিধা ‘নামমাত্র’

প্রবীণ হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা হাতে গোনা। ২ অক্টোবর মাত্র তিনজন রোগী ভর্তি ছিলেন। এর মধ্যে একজন প্রবীণ। প্রবীণদের জন্য হাসপাতাল হলেও সেখানে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ) নেই। অথচ প্রবীণদের শারীরিক জটিলতায় যখন-তখন আইসিইউতে নিয়ে সেবা দেওয়ার প্রয়োজন হয়।

সম্প্রতি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস মেশিন বসানো হয়েছে, এখান থেকে প্রবীণেরা আড়াই হাজার টাকায় ডায়ালাইসিস করার সুযোগ পাচ্ছেন। তবে ডায়ালাইসিসের সময় কোনো জটিলতা দেখা রোগীর আইসিইউ সেবা দেওয়ার উপায় নেই। হাসপাতাল ভবনের সঙ্গেই আছে একটি প্রবীণ নিবাস। বর্তমানে সেখান নিবাসী আছেন ৩৫ জন। এই প্রবীণেরাও বড় কোনো জটিলতায় এ হাসপাতালের ওপর ভরসা রাখতে পারেন না বলে বাইরের হাসপাতালে চিকিৎসা নেন বলে জানালেন।

কম টাকায় ভালো চিকিৎসকদের ধরে রাখা কঠিন হয়ে যায় উল্লেখ করে সংঘের বর্তমান মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন মোল্লা বলেন, বর্তমানে ১১ জন চিকিৎসক আছেন। আর নার্সসহ পুরো সংঘে কর্মরত আছে দেড় শ জন। তবে আইসিইউ, ডিজিটাল এক্স-রে মেশিনের মতো আরও অনেক কিছু জরুরি দরকার। আর প্রবীণ হাসপাতালের প্রচারের জন্যও টাকার প্রয়োজন।

প্রবীণ হাসপাতালে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত শয্যা রাখা হয়েছে। তবে মুক্তিযোদ্ধা বানানটিই সঠিকভাবে লেখা হয়নি
ছবি: মানসুরা হোসাইন

আয়ের একমাত্র উৎস প্রবীণ নিবাস

বাইগামের সাধারণ ও আজীবন সদস্যদের (প্রবীণ হতে হবে) মধ্যে নির্বাচনের পর নির্বাচিতদের নিয়ে তিন বছর মেয়াদি ২৫ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সদস্যরা সংঘ পরিচালনা করছেন। সদস্যদের চাঁদা, অনুদান, সংঘের প্রবীণ নিবাস থেকে আয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বরাদ্দে চলছে এই সংঘ ও হাসপাতাল।

সংঘের জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বরাদ্দ দিয়েছে ৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় করোনার জন্য আগের ২০ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে ১০ লাখ টাকা দিয়েছে। এ থেকে সংঘের কর্মরত ব্যক্তিদের বেতন ও ঢাকার বাইরের ৯২টি শাখায় কিছু অনুদান দেওয়া হয়।

সংঘের বর্তমান সভাপতি মো.আবদুল মাননান বললেন, প্রবীণেরা প্রবীণ হাসপাতালে স্বল্প খরচে চিকিৎসাসেবা নিতে পারছেন। সংঘের আজীবন সদস্যরা চিকিৎসায় ৫০ শতাংশ ছাড় পাচ্ছেন। বর্তমানে আজীবন সদস্যসংখ্যা সাড়ে তিন হাজার।

সংঘের আয়ের একমাত্র উৎস প্রবীণ নিবাস। মহাসচিবের দেওয়া হিসাব বলছে, এ নিবাস থেকে সংঘের মাসিক আয় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। আর নিবাসের জন্য নিরাপত্তাকর্মীসহ বিভিন্ন জনবল ও অন্যান্য খাতে খরচ হয় ১ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা কম, অস্ত্রোপচারের সংখ্যা কম হওয়ায় হাসপাতাল থেকে আয়ের তেমন সুযোগ নেই।

‘প্রবীণবান্ধব হাসপাতাল বলা যাবে না’

সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের রোগী ও প্রবীণ নিবাসীদের জন্য একটি লিফট ও দুটি অ্যাম্বুলেন্স আছে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই জানালেন, অ্যাম্বুলেন্স চিকিৎসকদের আনা–নেওয়াসহ অন্যান্য কাজেও ব্যবহার করা হয়। নারী ও পুরুষ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় প্রবীণ হাসপাতালে দুটি বিনা মূল্যের কেবিন রয়েছে। এ ছাড়া সাধারণ কেবিনের পাশাপাশি এসি কেবিনও রয়েছে।

আছে অস্ত্রোপচার–পরবর্তী সেবার কক্ষ। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকেই জানালেন, এখানে কর্মরত চিকিৎসকসহ অন্য কর্মীরা অস্ত্রোপচারের রোগীদের অন্য হাসপাতালে পাঠানোর পাঁয়তারা করেন। ফলে হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষে অস্ত্রোপচার হয় না বললেই চলে। ২ অক্টোবর শুধু একটি অস্ত্রোপচার হয়।

হাসপাতালটিতে এক্স-রে, প্যাথলজি, ইসিজি, আলট্রাসাউন্ড, ইকো-কার্ডিওগ্রাম, ফোরডি কালার আলট্রাসনোগ্রাম, রক্ত পরিসঞ্চালনসহ বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। সাধারণ মেডিসিন, জেরিয়াট্রিক মেডিসিন, ডায়াবেটিস, ফিজিওথেরাপি, নাক কান গলা, স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিভাগ, সার্জারি, চর্ম ও যৌন, অর্থপেডিকস, জরুরি বিভাগ, হারবাল, দাঁত, শিশু, চোখ, হৃদ্‌রোগসহ বিভিন্ন বিভাগে সকাল ও বিকেলে বহির্বিভাগে রোগীরা সেবা নিচ্ছেন।

প্রবীণ হাসপাতালের পরিচালক আবু আলতাফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রবীণদের চিকিৎসায় ইউরোলজি, নিউরোলজি, কার্ডিওলজি অর্থাৎ যে বিভাগগুলো জরুরি, তা এ হাসপাতালে নেই। সিটি স্ক্যান, এমআর বা এ ধরনের আধুনিক পরীক্ষার সুযোগ নেই। আইসিইউ নেই। এগুলো না হলে হাসপাতালটিকে প্রবীণবান্ধব হাসপাতাল বলা যাবে না।  

প্রবীণবান্ধব দেশ গড়ে তুলতে হবে

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রবীণদের আর্থসামাজিক ও স্বাস্থ্যগত অবস্থা, রোগাক্রান্ত হওয়ার ঘটনা, রোগের কারণ, সেবা ব্যবস্থাপনা নিয়ে সংঘের অনুসন্ধান করার কথা ছিল।

সংঘকে জরাবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে পরিণত করা, প্রবীণদের জন্য দিবাযত্নকেন্দ্র তৈরি, হোম কেয়ার সেবা দেওয়া, প্রবীণদের সেবা নিয়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা, প্রবীণদের কল্যাণে পরিবার ও সমাজভিত্তিক সেবা দেওয়া এবং প্রবীণদের নিয়ে সচেতনতা তৈরির কথা ছিল সংঘের নির্বাচিত সদস্যদের। তবে এগুলোর প্রায় কোনোটাই হয়নি।

বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদনে ২০১০ সাল থেকে ইনস্টিটিউট অব জেরিয়াট্রিক মেডিসিন (আইজিএম) নামে চিকিৎসাবিষয়ক একটি শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বর্তমানে চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স চালু রয়েছে।

ডিপ্লোমা কোর্সের পাঠ্যসূচিতে পর্যায়ক্রমে বার্ধক্য ও প্রবীণকল্যাণ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া চলছে। ইনস্টিটিউট অব জেরিয়াট্রিক মেডিসিন (আইজিএম) প্রফেশনাল প্রশিক্ষণের আওতায় প্যাথলজি, ফিজিওথেরাপি ও নার্সিংয়ে ডিপ্লোমা কোর্স পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়া বিদেশে কর্মসংস্থান তৈরিতে জেরিয়াট্রিক কেয়ার গিভিং সার্ভিস কোর্সেও প্রশিক্ষণ চলছে।

বাইগামের প্রবীণ নিবাসের ব্যবস্থাপক ও বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মহসীন কবির বললেন, জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান বার্ধক্য বিষয়ে নিজস্ব কোনো কোর্স পরিচালনা করছে না। তবে পিএইচডিসহ যাঁরাই বার্ধক্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে চান, তাঁদের এ প্রতিষ্ঠানের কাছে আসতেই হচ্ছে।

বর্তমানে স্থপতিরাও ভবন নির্মাণে প্রবীণদের বিষয়টি মাথায় রাখছেন বলে এখানে এসে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এ বিষয়গুলো ভবিষ্যতে প্রবীণবান্ধব বাংলাদেশ গড়তে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।