বসন্তের সন্ধ্যায় মিশেছিল কবিতার ছন্দ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে কবি মুহাম্মদ সামাদের কবিতাসন্ধ্যার আয়োজনে (বাঁ থেকে) আনিসুল হক, আসাদুজ্জামান নূর, এ এস এম মাকসুদ কামাল ও মুহাম্মদ সামাদ। ঢাকা, ১০ মার্চছবি: প্রথম আলো

বসন্তের সন্ধ্যায় মিশেছিল কবিতার ছন্দ, সুরের ছোঁয়াও থাকল শুরু আর শেষে। মাঝখানে কবিতা নিয়ে ও কবিকে নিয়ে স্মৃতির আলোয় কথার মালায় সাজানো উপভোগ্য এক আয়োজন।

বাংলা কবিতার অনুরাগীদের কাছে কবি মুহাম্মদ সামাদ অনেক দিনের চেনা। তাঁর কাব্য গুণমুগ্ধ বাংলাভাষী ছড়িয়ে আছেন দেশ-বিদেশের সর্বত্রই। এবার কবি রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদকেও ভূষিত হয়েছেন। পেশায় তিনি শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্যের (প্রশাসন) দায়িত্ব পালন করছেন। রোববার তাঁর কবিতা নিয়ে আবৃত্তিসন্ধ্যার আয়োজন করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। এই অনুষদের ওসমান জামাল মিলনায়তনে ছিল এই আয়োজন।

সূচনা ভাষ্যে অনুষদের ডিন শিল্পী নিসার হোসেন বললেন, অনেক আগেই এই মিলনায়তনে কবি মুহাম্মদ সামাদের কবিতা আবৃত্তির আয়োজন করতে চেয়েছিলেন বাচিক শিল্পী হাসান আরিফ। তিনি প্রয়াত হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। এখন কবির একুশে পদক প্রাপ্তি বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের জন্যই আনন্দ ও সম্মানের উপলক্ষ হয়ে উঠছে। তা উদ্‌যাপন করতেই এই কবিতাসন্ধ্যার আয়োজন।

শিল্পী সুমা রানী রায়ের পরিবেশনায় ‘অরূপ তোমার বাণী’ গানটি দিয়ে শুরু হলো আনুষ্ঠানিকতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল কবিকে শুভেচ্ছা জানালেন তাঁর হাতে পুষ্পস্তবক তুলে দিয়ে। তিনি বললেন, কবিরা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হয়ে থাকেন। তাঁরা দেশ ও জাতির গভীর সত্যকে উপলব্ধি করতে পারেন। কবি মুহাম্মদ সামাদ তেমনি এক বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব। যখন দেশের দুর্দিন, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কেউ সাহস করে প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারেননি, তখন তিনি গভীর ভালোবাসায় হৃদয় দিয়ে তাঁর কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরেছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যখন কোনো লেখা হয়, তখন তা হয়ে ওঠে দেশের জন্য, মানুষের জন্য লেখা।

এরপর আবৃত্তি। ‘আমি তোমাদের কবি, তোমরা আমাকে নাও’—কবির এই জনপ্রিয় কবিতাটি আবৃত্তি করেন বাচিকশিল্পী ও অধ্যাপক রূপা চক্রবর্তী। তিনিও এবার একুশে পদক পেয়েছেন।

এরপর মুহাম্মদ সামাদের কবিতার নানা দিক নিয়ে আলোচনা করলেন কথাসাহিত্যিক ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক। তিনি কবির সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের সাহচর্যের স্মৃতিচারণা করলেন। বললেন, কবি মুহাম্মদ সামাদ খুবই আবেগপ্রবণ মানুষ। গভীর সংবেদনশীলতার সঙ্গে দেশ, সংস্কৃতি, মানবিক মূল্যবোধের বিষয়গুলো তিনি কবিতায় তুলে এনেছেন। বাংলাদেশ কী, বাঙালি কী, বঙ্গবন্ধু কে, কেন—এসবের খুব ভালো ব্যাখ্যা হলো মুহাম্মদ সামাদের কবিতা। তিনি আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে প্রাসঙ্গিক দৃষ্টান্ত হিসেবে কবির কবিতা থেকে পাঠ করে শোনান। প্রকারান্তরে তাঁর আলোচনাও প্রায় আবৃত্তি হয়ে উঠেছিল।

এরপরে আর কথা নয়। দেশের স্বনামখ্যাত বাচিকশিল্পীরা আবৃত্তি করে শোনালেন কবির বিভিন্ন আঙ্গিক ও বিষয়বৈচিত্র্যের কবিতা। এবার একুশে পদকপ্রাপ্ত শিমুল মুস্তাফা আবৃত্তি করলেন ‘একটি যুবক’, মাহিদুল ইসলাম শোনালেন ‘আমার দুচোখ জলে ভরে যায়’, নায়লা তারান্নুম আবৃত্তি করলেন ‘আজ পয়লা আষাঢ়, আজ বৃষ্টি’, তামান্না সারোয়ারের কণ্ঠে এল ‘এই বাংলা মুজিবময়’। শেষে আবৃত্তি করলেন সঞ্চালক শাহাদত হোসেন ‘বাঙালির কনিষ্ঠ ভূমিপুত্রের নাম’ কবিতাটি।

প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে এসে কবি মুহাম্মদ সামাদ বললেন, শৈশবে মায়ের কাছ থেকেই তিনি কবিতার প্রতি অনুরক্ত হয়েছিলেন। তবে ভাবেননি কবিতার জন্য এত মানুষের ভালোবাসা পাবেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কবিতা পড়তে গেছেন, দেশের উজ্জ্বল কবিদের সঙ্গে জীবনের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছেন। এই যে আয়োজন হলো, এর জন্যও তিনি সবার প্রতি ঋণী ও কৃতজ্ঞ।

সভাপতি ছিলেন নন্দিত নাট্যজন ও বাচিকশিল্পী সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর। তিনিও স্মৃতিচারণা করে বললেন, কবি মুহাম্মদ সামাদ কেবল কবিতাই লেখেননি, স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন, জাতীয় কবিতা পরিষদ ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কবি হিসেবে তিনি সাহসী ও স্পষ্টবাদী মানুষ। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পরিচয়’ কবিতাটি আবৃত্তি করে কবি মুহাম্মদ সামাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

শেষে আবার গান শোনাতে এলেন সুমা রানী রায়। তিনি অতুল প্রসাদের আমি অকৃতি অধম এবং বসন্তদিনে কবিগুরুর বসন্তের গান ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়’ গেয়ে অনুষ্ঠানের যবনিকা টেনে দিলেন।