দুই বছরে অর্ধেক সীমানাখুঁটিও বসেনি

মিরপুরের দারুসসালাম এলাকায় বাংলাদেশ কোরিয়া টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার ছাত্রাবাসের পেছনে বসানো হয়েছে একটি সীমানাখুঁটি। খুঁটির ২০০ মিটারের মধ্যে খালের কোনো অস্তিত্ব নেইছবি: প্রথম আলো

অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ২৯টি খাল ও একটি জলাধারের সীমানা নির্ধারণ ও খুঁটি বসানোর কাজে গতি নেই। দুই দফা প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে কাজের অর্ধেকও শেষ হয়নি। এখন তৃতীয় দফায় কাজের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
এদিকে সিএস জরিপের নকশা মেনে খালের সীমানা নির্ধারণ ও খুঁটি বসানোর কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। কোনো খালে সিএস জরিপ, কোনো খালে আরএস জরিপ; আবার কোনো খালে সিটি জরিপের নকশা ধরে খুঁটি বসানো হয়েছে। আবার কোনো খালের বিভিন্ন অংশে ভিন্ন ভিন্ন জরিপের নকশা মেনে খুঁটি বসানো হয়েছে।

মাত্র পাঁচ ফুটের ব্যবধানে বসানো হয়েছে দুটি সীমানাখুঁটি। গত শনিবার রাজধানীর মিরপুরের আলমনগর এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

২০২২ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া প্রকল্পের মেয়াদ ওই বছরের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে আরও দুই দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে গত বছরের ডিসেম্বরে কাজ শেষ হওয়ার কথা। তা-ও না হওয়ায় এবার কাজ আরও ৬ মাস (আগামী জুন পর্যন্ত) বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের চুক্তিমূল্য ধরা হয়েছিল ২৭ কোটি টাকা।
ডিএনসিসির কর্মকর্তারা বলছেন, সিএস (ক্যাডেস্টাল সার্ভে) জরিপের নকশা অনুযায়ী খালের সীমানাখুঁটি বসাতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ জায়গা বেদখল হয়ে গেছে। খাল দখলকারীদের মধ্যে ব্যক্তি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এ ছাড়া খালের জায়গা দখল করে অনেক জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
ডিএনসিসির আওতাধীন ‘২৯টি খাল এবং একটি জলাধারের সীমানা নির্ধারণ, সীমানা নির্দেশক পিলার (খুঁটি) স্থাপন এবং জিআইএস ডেটাবেইস তৈরি’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় মোট ১ হাজার ৯১০টি খুঁটি বসানোর কথা। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮৫৮টি সীমানাখুঁটি বসানো হয়েছে। এর মধ্যে ৫২টি খুঁটি সিটি জরিপ এবং ১০৫টি খুঁটি বসানো হয়েছে আরএস (রিভিশনাল সার্ভে) জরিপের নকশা অনুযায়ী। বাকি ৭০১টি খুঁটি বসেছে সিএস জরিপ ধরে।

এক খালে তিন জরিপের খুঁটি

ডিএনসিসি সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর মিরপুর এলাকার বাউনিয়া খালের দৈর্ঘ্য ৮ দশমিক ৮২৮ কিলোমিটার। খালটিতে ৬০টি সীমানাখুঁটি বসানো হয়েছে। এর মধ্যে ১৯টি খুঁটি আরএস জরিপের নকশা মেনে বসানো হয়েছে। বাকি ২০টি খুঁটি আরএস এবং ২১টি খুঁটি বসানো হয়েছে সিটি জরিপের নকশা অনুযায়ী।
একইভাবে মিরপুরের ইব্রাহিমপুর খালে বসানো ১৯টি খুঁটির মধ্যে ৯টি এবং দ্বিগুণ খালের ৪৩টি খুঁটির মধ্যে ৪টি খুঁটি বসানো হয়েছে সিটি জরিপের নকশা ধরে। এর বাইরে এখন পর্যন্ত কল্যাণপুর ‘ম খালে’ বসানো দুটি খুঁটি, রূপনগর (আরামবাগ) খালের দুটি খুঁটি, সাংবাদিক কলোনি খালের পাঁচটি খুঁটি এবং বাইশটেকি খালে বসানো নয়টি খুঁটির সব কটিই সিটি জরিপ অনুযায়ী বসানো।
ডিএনসিসির ড্রেনেজ শাখার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ফারুক হাসান মো. আল মাসুদ এবং পরিকল্পনা ও নকশা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী তাবাসসুম আবদুল্লাহ এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

মিরপুরের বাইশটেকি এলাকার বাউনিয়া খালের এ অংশে দখল থাকলেও কোনো খুটি বসানো হয়নি
ছবি: প্রথম আলো

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানালেন, ডিজিটালি সীমানা চিহ্নিতকরণের কাজ (জিআইএস ডেটাবেইস) শেষ। কিন্তু খুঁটি স্থাপনের কাজ শেষ হয়নি।
সীমানা নির্ধারণ প্রকল্প নিয়ে ভূমি আইন সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ এমন অবসরপ্রাপ্ত একজন সরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সীমানা নির্ধারণে ডিএনসিসির কাজ নিয়ে ভবিষ্যতে জটিলতা হবে। কারণ, আইন অনুযায়ী সর্বশেষ প্রজ্ঞাপন হওয়া জরিপের নকশা অনুসরণ করতে হবে। আগের জরিপগুলো শুধু দেওয়ানি আদালতে মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সে অনুযায়ী খালের সীমানা নির্ধারণে সিটি জরিপকে প্রাধান্য দেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু তা না করে সিএস ও আরএস জরিপ ধরে খুঁটি পোঁতা হয়েছে।

নাম-নিশানা নেই খুঁটিতে

গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ও ২ মার্চ প্রকল্পের আওতাধীন ৮টি খাল ও কল্যাণপুর জলাধার ঘুরে দেখেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। এর মধ্যে কল্যাণপুর জলাধারসহ কল্যাণপুর মূল খাল, রামচন্দ্রপুর, রূপনগর, দ্বিগুণ, সাংবাদিক কলোনি, বাইশটেকি, কাটাসুর ও বাউনিয়া খাল রয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, সীমানাখুঁটিগুলো কম দৃশ্যমান। খুঁটির মধ্যে ক্রমিক নম্বর, খাল ও মৌজার নামসংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই।
মিরপুর দারুসসালাম এলাকায় বাংলাদেশ কোরিয়া টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের (বিকেটিটিসি) ভেতরে এমন তিনটি সীমানাখুঁটি বসেছে। এর একটি বিকেটিটিসির ছাত্রাবাসের পেছনে। খুঁটিটির ধারেকাছে খাল-জলাধার কিছুরই অস্তিত্ব নেই। খুঁটি থেকেও প্রায় ২০০ মিটার দক্ষিণে কল্যাণপুর খাল। এ বিষয়ে বিকেটিটিসির অধ্যক্ষ লুৎফর রহমানের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

মিরপুরের রূপনগর টিনশেড এলাকার ৭ নম্বর সড়কের শেষে রূপনগর খালে একটি খুঁটি দেখা গেছে। মিরপুর-১১ নম্বরের সাংবাদিক কলোনি খালে শুধু এক পাড়ে খুঁটি আছে। অন্য পাড়ে খালের ওপর ভাসমান অবস্থায় অবৈধ দখলদার রয়েছে। সেখানেই আলমনগর এলাকায় একটি ফাঁকা জায়গায় প্রায় ৫ ফুট ব্যবধানে পাশাপাশি দুটি সীমানাখুঁটি বসানো হয়েছে। অথচ খালটি এই দুই খুঁটির বাইরে পড়েছে।
মোহাম্মদপুরের বছিলা এলাকায় রামচন্দ্রপুর খালের পাড়ে নুরুল আলম নামের এক ব্যক্তির ভবনের আংশিক ভেঙেছে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ। নুরুল আলম বলেন, ‘খুঁটি বসানোর সময় বলা হয়েছিল, আমার বাড়ি খালের জায়গার মধ্যে পড়েনি। কিন্তু অভিযানে এসে সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, খুঁটি ভুল স্থানে বসানো হয়েছে।’
জরিপ পুরোপুরি শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করা যাচ্ছে না উল্লেখ করে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি জরিপের নকশা ধরেই ডিজিটালি সীমানা নির্ধারণ করা হচ্ছে। বাস্তবে বেশির ভাগ খুঁটি সিএস জরিপ অনুযায়ী বসছে। কিছু কিছু খুঁটি এর বাইরেও পড়েছে। মাঠপর্যায়ে কিছু বিষয় থাকে, যেগুলোর মুখোমুখি হতে হয়।