যে শিক্ষায় চাকরি খোঁজা প্রধান পদ্ধতি, তা শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে পারে না: সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

‘দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য শিক্ষা’ শীর্ষক এই আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামছবি: প্রথম আলো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন, বাংলাদেশে যে উপায়ে শিক্ষা দেওয়া হয় তাতে আদর্শিক শিক্ষার ছায়াপাত সামান্যই। যে শিক্ষায় মুখস্থ করা, পরীক্ষা দেওয়া ও পাস করা এবং পড়াশোনা শেষে চাকরি খোঁজা প্রধান পদ্ধতি হয়ে দাঁড়ায়, তা সমাজে বা দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে পারে না।

আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস ২০২৪ উপলক্ষে আজ বুধবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এক আলোচনা সভায় মুখ্য আলোচকের বক্তব্যে শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এসব কথা বলেন। ‘দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য শিক্ষা’ শীর্ষক এই আলোচনা সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ ইউনেসকো জাতীয় কমিশন এবং ইউনেসকোর ঢাকা অফিস।

আলোচনা সভায় ঢাকার বাইরে থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী রুমানা আলী।

অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আরও বলেন, বাংলাদেশে যে উপায়ে শিক্ষা দেওয়া হয় এবং শিক্ষার্থীরা যে উপায়ে তা গ্রহণ করে, তাতে আদর্শিক শিক্ষার ছায়াপাত সামান্যই; যে শিক্ষা মুখস্থ করা, পরীক্ষা দেওয়া ও পাস করা এবং পড়াশোনা শেষে চাকরি খোঁজা প্রধান পদ্ধতি হয়ে দাঁড়ায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে শিক্ষাকে সেভাবে রূপান্তর করা হয়েছে। তা সমাজে বা দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে পারে না। এই শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে কোচিং ও নোট বই ব্যবসা। এটি যথাযথভাবে বাজারমুখীও হয় না। তাই এর রূপান্তর প্রয়োজন।

অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল বলেন, তাঁকে ব্যাংকের অনেক বড় কর্মকর্তা বলেছেন ভালো একজন ‘কমিউনিকেটর’ পান না। অনেক দেশ থেকে উচ্চতর ব্যবস্থাপক যাদের ‘সুপার ম্যানেজার’ বলা হয়, তাঁরা বাংলাদেশে এসে কাজ করছেন। বিপুল পরিমাণ ডলার দেশ থেকে চলে যাচ্ছে। অথচ প্রবাসী শ্রমিক, যাঁরা রোদে পুড়ে, ঘামে ভিজে কাজ করছেন, তাঁরা যে অর্থ পান, তার একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে ওই সব ‘সুপার ম্যানেজারদের’ হাত ধরে। এখন হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও আসছেন দেশের বাইরে থেকে। এমন একটা দিন আসবে, যখন সুব্যবস্থাপক পাওয়ার জন্য হয়তো লুণ্ঠন হাতে বের হতে হবে। এটি একটি লজ্জার বিষয় যে শিক্ষায় সেই আলোকপ্রাপ্ত মানুষ তৈরি করা যায়নি।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, আদর্শিক শিক্ষার সঙ্গে এমন একটি শিক্ষাপদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে, যেটি সত্যিকার অর্থে ফলদায়ক হবে। তিনি বলেন, ‘রূপান্তরের লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়েছে। আমি আশা করি সেই রূপান্তরের লক্ষ্যে আমরা অগ্রসর হয়ে যাব। আমরা যেন মুখস্থনির্ভর, পরীক্ষানির্ভর—এই পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসি। এটি সন্তানদের জন্য ভয়ানক চাপ সৃষ্টি করে।’

আদর্শিক শিক্ষার বিভিন্ন রূপ তুলে ধরে শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, এই আদর্শিক রূপের সঙ্গে মাঠপর্যায়ে যে শিক্ষা দেওয়া হয় এবং শিক্ষার যেসব পদ্ধতি শিখন-শিক্ষণ ও অন্যান্য কার্যক্রমের রূপরেখা ও প্রয়োগ নিশ্চিত করে, সেগুলোকে মেলাতে হবে। এই মেলবন্ধন না হলে আদর্শিক শিক্ষা থাকবে একদিকে আর প্রায়োগিক শিক্ষা যেটি মাঠপর্যায়ে দেওয়া হয়, সেটি থাকবে আরেক দিকে। এই মেলানোর কাজটিই সবচেয়ে কঠিন।

আদর্শিক বা উৎকৃষ্ট শিক্ষা প্রদানে একটি বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, উৎকৃষ্ট বা উঁচু মানের শিক্ষা অনেক বিষয়েই সংবেদনশীল। যেমন সংঘাত, প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত ভারসাম্য, সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ ইত্যাদি। শিক্ষা যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক না হয়, যদি তা সুষম না হয়, তাহলে এর ফল হতে পারে বিপরীত।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ ও সংঘাতের চলমান পরিস্থিতি তুলে ধরে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আরও বলেন, যেকোনো সংঘাত সভ্যতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংঘাত কোনো সমাধান দেয় না।

আলোচনার ধারণাপত্রের প্রসঙ্গ টেনে সৈয়দ মনজুরুল বলেন, বিশ্বে এখন যেসব সংঘাত চলছে, তাতে শান্তি তিরোহিত হয়েছে। এই সংঘাত এড়াতে অথবা সংঘাত শুরু হলে সেই সময় শান্তি নিশ্চিত করতে শিক্ষা আদৌ কোনো ভূমিকা রেখেছে? পশ্চিমের প্রায় সব দেশের শিক্ষাব্যবস্থা উঁচুদরের, ধারণাপত্রের ভাষায় রূপান্তরিত ও উচ্চ সুযোগ-সুবিধা সংবলিত। তাহলে সেসব দেশের শিক্ষা শান্তি প্রতিষ্ঠায় বা রক্ষায় কোনো ভূমিকা রাখতে কেন ব্যর্থ?

অধ্যাপক মনজরুল ইসলাম বলেন, পশ্চিমের অনেক দেশকে বরং মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতেও দেখা গেছে। এ ছাড়া বিশ্বের অনেক দেশের মতো পশ্চিমের কয়েকটি দেশের যে উগ্রবাদী চিন্তাভাবনা বিস্তার লাভ করছে, যার প্রভাবে সমাজে বিদ্বেষ-হিংসা বাড়ছে, যা সংঘাতে গড়াতে সময় নেয় না। তা এড়াতে শিক্ষা কেন ব্যর্থ হচ্ছে? এই কথার উল্লেখ করা হলো এই চিন্তাটি প্রতিষ্ঠার জন্য নয় যে সংঘাত ঠেকাতে শিক্ষা ব্যর্থ; বরং কেন ব্যর্থ, তা জেনে শিক্ষাকে আরও রূপান্তরিত করা এবং তাকে শান্তি প্রতিষ্ঠার উপযুক্ত করার পথ খোঁজার প্রয়োজনীয়তা পুনরুচ্চিত করার জন্য।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব খালেদা আক্তার অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের সদস্য অধ্যাপক গুলশান আরা লতিফা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসচিব ফরিদ আহম্মদ, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আজিজ তাহের খান, ইউনেসকো ঢাকা অফিসের প্রধান সুজান ভাইজ, বাংলাদেশ ইউনেসকো জাতীয় কমিশনের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল জুবাইদা মান্নান।