বাটনা, পিষণি, কুমড়ো বড়ি, বেনারসি শাড়ি—সবই পাওয়া যাচ্ছে

ধানমন্ডির ২৭ নম্বরে মাইডাস সেন্টারের ১০ম তলায় এ মেলার আয়োজন করেছে মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স সার্ভিস বা মাইডাসছবি: সাজিদ হোসেন

খোদাই করা মাটির প্লেট বা বাটনায় বাঁশের শিকড় দিয়ে বানানো পিষণি দিয়ে আলুসহ যেকোনো ভর্তা বানানো যাবে। মাংসের শুঁটকি, কুমড়ো বড়ি, রংপুরের শতরঞ্জি, রংপুরের মগা সিল্ক, বেনারসি, সিল্কের কাতান শাড়ি, খয়েরসহ বিভিন্ন জিনিসের রং দিয়ে বানানো ন্যাচারাল ডাইয়ের পোশাক, আসল মুক্তার গয়না, গান ও কবিতা লেখা বর্ষার শাড়িসহ নানা পোশাক, পাবনার লুঙ্গি, রিকশাচিত্রের গয়নার বাক্সসহ হরেক রকমের পণ্যের পসরা নিয়ে রাজধানীতে শুরু হয়েছে মাইডাস এসএমই মেলা।

ধানমন্ডির ২৭ নম্বরে মাইডাস সেন্টারের ১০ম তলায় এ মেলার আয়োজন করেছে মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স সার্ভিস বা মাইডাস। এটি একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের আর্থিক, কারিগরি ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সহায়তা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় নারী উদ্যোক্তাদের তৈরি পণ্যের এ মেলার উদ্বোধন করেন মাইডাস ফাইন্যান্সিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান আলী ইমাম মজুমদার, মাইডাসের পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক পারভিন মাহমুদ, প্রথম আলোর ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও যুব কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক মুনির হাসান, মাইডাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাইরুল বাশার, মাইডাসের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. ইব্রাহিম হোসেনসহ অন্য অতিথিরা।

ঢাকা, রংপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে নারী উদ্যোক্তারা মেলায় অংশ নিয়েছেন। ৬০টি স্টলের এ মেলা চলবে ২৩ মার্চ পর্যন্ত। সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এ মেলা সবার জন্য উন্মুক্ত।

ফিতা কেটে মেলার উদ্বোধন করা হয়
ছবি: সাজিদ হোসেন

ফিতা কেটে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর অতিথিরা বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন এবং উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মাইডাস ফাইন্যান্সিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, মেলায় অংশ নেওয়া নারী উদ্যোক্তারা সাহস নিয়ে এগিয়ে চলছেন। তাঁদের উদ্যম আছে। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পেলে এবং লেগে থাকলে এই নারীরা ব্যবসায় অনেক ভালো করবেন।
পারভীন মাহমুদ বলেন, নারী উদ্যোক্তাদের পণ্যের মধ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে।

বর্তমানে অনেক নারী উদ্যোক্তাই পরিবেশবান্ধব পণ্য নিয়ে ব্যবসা করছেন। এ মেলাতেও ন্যাচারাল ডাইয়ের পোশাকের প্রাধান্য চোখে পড়ছে। মেলা শেষে উদ্যোক্তাদের মধ্যে যাঁরা পরিবেশবান্ধব পণ্য, দেশীয় পণ্যের পসরা নিয়ে বসেছেন, প্যাকেজিংয়ে প্লাস্টিক বর্জনসহ নতুন উদ্যোগ নিয়েছেন, তাঁদের পুরস্কৃত করা হবে।
পারভীন মাহমুদ বলেন, ‘মেলায় অংশ নেওয়া নারী উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। তাঁদের কোন জায়গায় গ্যাপ বা চ্যালেঞ্জ আছে, তা জানতে চেয়েছি। এই গ্যাপ পূরণে নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ নানা বিষয়ে মাইডাসের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হবে।’

করোনার ধকল পিছু ছাড়েনি

‘মানেরা’ উদ্যোগের উদ্যোক্তা সাইদা ইয়াছমিনের ধানমন্ডিতে ৬টিসহ মোট ১৭টি আউটলেট ছিল। বিভিন্ন পোশাকের পাশাপাশি জুয়েলারি, থাইল্যান্ডের জুতাসহ নানা পণ্য বিক্রি করতেন। তবে করোনায় সব আউটলেটই বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। প্রায় ৬০ কর্মীর বেতনসহ অন্যান্য খরচ দিয়ে পোষাতে পারছিলেন না তখন। ১৮ বছর ধরে ব্যবসা করা সাইদা করোনা চলে গেলেও আর কোনো আউটলেট চালু করতে পারেননি। এখন অনলাইনেই চলছে তাঁর ব্যবসা।

হরেক রকমের পণ্য নিয়ে ৬০টি স্টলের এ মেলা চলবে ২৩ মার্চ পর্যন্ত
ছবি: প্রথম আলো

২০ বছর ধরে বুটিকসের ব্যবসা করা নীলুফা আক্তারও জানালেন একই কথা। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাবেক সংবাদ উপস্থাপক নীলুফা জানালেন, করোনার আগে ধানমন্ডিতে প্লাজা এ আর শপিং মলে ‘নীলাস ক্রিয়েশন’ নামের দোকান ছিল। করোনায় দোকান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, এখন অনলাইনে ব্যবসা করছেন।

১৯৯৬ সাল থেকে ব্যবসা করা অয়ন ক্র্যাফটসের উদ্যোক্তা নাইমা ইসলাম বললেন, করোনায় ব্যবসার যে ক্ষতি হয়েছিল, তা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো বেশ কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। মোহাম্মদপুরে তাঁর ন্যাচারাল ডাইয়ের কারখানা আছে। জানালেন, বর্তমানে সবকিছুর দাম বেশি, ফলে পোশাকের দামও বাড়াতে হয়েছে। সব মিলে ব্যবসা ভালো যাচ্ছে, তা বলা কঠিন।

কেউ চাকরি ছেড়েছেন, কেউ চাকরির পাশাপাশি ব্যবসা করছেন

কারুনীলের উদ্যোক্তা ফাতেমা সাইয়েদা তিন বছর ধরে ব্যবসা করছেন। এর আগে ১৪ বছর একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। দুই মেয়েকে স্কুলে আনা–নেওয়াসহ অন্যান্য দায়িত্ব পালনের জন্য চাকরিটা তিনি ছেড়ে দেন। এসএমই ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে গয়না বানানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি।

অনলাইনে তাঁর পণ্যের বিক্রি বেশ ভালোই হয়। তাঁর নিজস্ব নকশায় কবিতা ও গান লেখা ঋতু বৈচিত্র্যের শাড়ি, বিশেষ করে বর্ষার মেঘ ও ছাতা আঁকা শাড়ি ক্রেতারা বেশ পছন্দ করেন। এসব শাড়ির দাম ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। বিভিন্ন মেলায় অংশ নিলে, পরিচিতি বাড়লে বিক্রি বাড়ে বলেও উল্লেখ করেন ফাতেমা।
‘লং স্প্রিং’–এর উদ্যোক্তা মালিহা ওয়াদুদ আগে সাংবাদিকতা করতেন। সাংবাদিকতা ছেড়ে বর্তমানে তিনি ভারত থেকে আনা বিভিন্ন সুগন্ধী আগরবাতি, ছোটদের খেলনাসহ নানা পণ্য বিক্রি করছেন। আগরবাতির জন্য একটি ক্রেতা শ্রেণি তৈরি হয়েছে বলে জানালেন তিনি।

সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এ মেলা সবার জন্য উন্মুক্ত
ছবি: প্রথম আলো

একটি এনজিওতে কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট হিসেবে কাজ করতেন আসমা উল হুসনা। বেতন পেতেন প্রায় ৯০ হাজার টাকা। তবে বিভিন্ন কারণে তিনি চাকরিটি ছেড়ে দেন। দেড় বছর ধরে তিনি ‘যাদুর হাট’ নামের উদ্যোগ চালু করেছেন। মসলিন, সুতিসহ নানা দেশীয় শাড়ি, চাদরসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করছেন তিনি।

ব্যাংকার আফরিন পারভেজ মেলায় দ্রুত হাতে স্টল সাজাচ্ছিলেন। স্টল সাজানো শেষ করেই ছুটতে হবে তাঁর কর্মক্ষেত্রে। সাড়ে তিন বছর আগে লিটল ক্রিয়েশন চালু করেছেন তিনি। আফরিন পারভেজের আশপাশের স্টলের নারী উদ্যোক্তারা জানালেন, আফরিন চলে গেলে অন্য নারী উদ্যোক্তারাই তাঁর পণ্য বিক্রির দায়িত্ব নেবেন।

ঝামেলার মধ্যে মালিহা ওয়াদুদ তাঁর মুঠোফোনটি ভুলে অন্য এক নারী উদ্যোক্তার স্টলে ফেলে এসেছিলেন। ওই নারী উদ্যোক্তা ফোনটি দিতে এলে মালিহা বললেন, এভাবেই নারী উদ্যোক্তারা একজন আরেকজনের পাশে থাকেন।

নকল পণ্য ও পণ্য নিয়ে দুই নম্বরির ফল ভোগ করেন নারী উদ্যোক্তারা

‘তাহার’ নামের উদ্যোগটিতে মুক্তার নানা গয়না পাওয়া যাচ্ছে। এর উদ্যোক্তা স্থপতি ফারাহ নাজ। তিনি বলেন, নিজে মুক্তার গয়না পছন্দ করেন বলে শখের বশে এ উদ্যোগ চালু করেছেন। তবে নকল মুক্তার গয়নায় বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। ক্রেতারা আসল মুক্তার গয়না দেখেও সন্দেহ করেন। দাম দিয়ে কিনতে চান না।

ফারাহ নাজ ক্রেতাদের সুবিধার জন্য তাঁর স্টলে কিছু নকল মুক্তার গয়নাও রেখেছেন। জানালেন, নকল মুক্তার গয়না অনেক হালকা হয়। আর আসল মুক্তার গয়না ভারী এবং অনেক বেশি ঠান্ডা হয়।

ফিতা কেটে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর অতিথিরা বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন এবং উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলেন
ছবি: প্রথম আলো

রংপুরের ‘তে রংগা’র উদ্যোক্তা আতিকা রহমান শতরঞ্জিসহ নানা পণ্য নিয়ে স্টল দিয়েছেন। বেনারসি কাতান, সিল্কসহ নানা শাড়ি দেখিয়ে বললেন, এগুলো দেশের তাঁতিরা তৈরি করছেন। এই শাড়িগুলোই কিনে কেউ কেউ তাতে ভারতীয় শাড়ির সিল বসিয়ে আবার বিক্রি করছেন। এতে ক্রেতারা ঠকছেন।

মেলায় ঘুরে দেখা গেল, সুবার্তা সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজের খাঁটি কৃষিতে ছোট ছোট করে টুকরা করা শুকনা মিষ্টি আলু, খই, দুধের সরের ঘি, শজনে, পুদিনা, তুলসী, ধনেপাতা, পাটপাতার গুঁড়া, যবের ছাতু, কুমড়ো বড়ি, শুকনা কাঁঠাল, কুমড়ার বিচি, কালো বিন্নি চাল, বাদাম, কালিজিরার তেল, ধনে ফুল, লিচু ফুল, কালিজিরা ফুলের মধুসহ নানা পণ্য পাওয়া যাচ্ছে।

মেলায় ওয়ান কালচার রিকশাচিত্রের বিভিন্ন পণ্যের পসরা নিয়ে বসেছে। ২০ বছর ধরে ব্যবসা করছেন জারিনস ক্রিয়েশনের উদ্যোক্তা আফরোজা সুলতানা। তিনি জানান, ন্যাচারাল ডাইয়ের পোশাকের দাম একটু বেশি হলেও যে ক্রেতারা ভালো পণ্য খোঁজেন, তাঁরা ঠিকই কেনেন। ২ হাজার ৮০০ টাকা থেকে শুরু করে ১৫ হাজার টাকা দামে শাড়ি বিক্রি হচ্ছে। খয়ের দিয়ে রং করা একটি শাড়ি দেখিয়ে জানান, শাড়িটির দাম ১৫ হাজার টাকা। ক্রেতাদের সুবিধার জন্য ন্যাচারাল ডাইয়ের পোশাক শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে তা ছায়ায় শুকানোর পরামর্শ দিলেন এই উদ্যোক্তা।