সূর্য উঠলেও কুয়াশার ঘোর তখনো কাটেনি ভালো করে। ঘুমের জড়তা ভেঙে কর্মমুখরতা ছড়িয়ে পড়েনি রাজধানীর বুকে। কিন্তু মহানগরীর উত্তর প্রান্তে আশুলিয়ার বিনোদনকেন্দ্র ফ্যান্টাসি কিংডমে ছড়িয়ে পড়েছে এক আনন্দময় প্রাণচাঞ্চল্য।
হাজার হাজার কৃতী শিক্ষার্থীর উচ্ছ্বসিত সমাগমে শীতের আড়মোড়া ভেঙে নবীন প্রাণের অমিত শক্তিতে জেগে উঠছে কল্পরাজ্যের এই রাজধানী। আজ সোমবার প্রভাতে কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দিতে প্রথম আলো এই আনন্দ উৎসবের আয়োজন করেছে শিক্ষার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ‘শিখো’র পৃষ্ঠপোষকতায়।
এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া কৃতী শিক্ষার্থীদের নিয়ে ‘শিখো-প্রথম আলো জিপিএ-৫ সংবর্ধনা’ নামের এই আয়োজন এবার শুরু হয়েছে ১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে। সারা দেশের ৬৪ জেলায় পর্যায়ক্রমে কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনার এই আয়োজন করা হবে। এরই ধারাবাহিকতায় রাজধানীতে আজ থেকে শুরু হয়েছে দুই দিনব্যাপী ঢাকা বিভাগের শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা। ঢাকায় সংবর্ধনা দেওয়া হবে ১৮ হাজার শিক্ষার্থীকে। আজ প্রথম দিনে সংবর্ধনায় অংশ নিচ্ছে প্রায় আট হাজার শিক্ষার্থী।
এবার সারা দেশে প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। তাদের মধ্যে থেকে সংবর্ধনার জন্য নিবন্ধন করেছে এক লক্ষাধিক শিক্ষার্থী। প্রথম আলো তার যাত্রা শুরু থেকেই নতুন প্রজন্মের কৃতী শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত, অনুপ্রাণিত করতে তাদের সংবর্ধনা দিয়ে আসছে। ১৯৯৯ সালে শুরু হয়েছিল মেধা তালিকায় সেরাদের সংবর্ধনা দেওয়া।
জিপিএ পদ্ধতি শুরু হওয়ার পর ২০০১ সাল থেকে চলছে সারা দেশে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দেওয়ার এই বিপুল আয়োজন। এবার সংবর্ধনার এই আয়োজনে সহযোগিতা করছে ফ্রেশ, কনকর্ড, এটিএন বাংলা ও প্রথম আলো বন্ধুসভা। অনুষ্ঠানে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল।
সকাল সাতটায় ফার্মগেট থেকে নিজেদের গাড়িতে করে ফ্যান্টাসি কিংডমের দিকে রওনা দিয়েছিল সাইরা আলী ও তার মা সেলিনা আক্তার। তেজগাঁও গার্লস স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাস করে ভর্তি হয়েছে ঢাকা কলেজে। সাইরা জানাল, প্রায় দেড় ঘণ্টা লেগেছে পৌঁছাতে। এসে মা-মেয়ে দুজনেই দারুণ উচ্ছ্বসিত। সাইরা লম্বা লাইন দিয়ে খাবারের কুপন সনদ নিয়ে আবার লাইন দিয়েছে রাইডের সামনে। চরকিতে উঠবে।
তার বন্ধু তনুজা ঢালী আর তাসফিয়া কামরুনও এসেছে এখানে। সে ফোন করছিল তাদের। ওদের সঙ্গে দেখা হলে তিনজনে মিলে একসঙ্গে মজা করে ঘুরবে। উৎসব মঞ্চের অনুষ্ঠান হবে বেলা একটা থেকে। তবে আনন্দ উৎসব শুরু সকাল আটটা থেকেই। ফ্যান্টাসি কিংডমের প্রবেশপথের পাশের খোলা জায়গায় একসারি বুথ। সেখানে আগে থেকে করা নিবন্ধনপত্রটি দেখিয়ে প্রবেশের কুপন নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছিল শিক্ষার্থীরা। অভিভাবকেরা অবশ্য কাউন্টার থেকেই টিকিট কেটে প্রবেশ করছিলেন।
মেয়ে নাজিয়া হাসানকে নিয়ে এসেছেন নূরুল হাসান। তিনি পুলিশ কর্মকর্তা, ঢাকাতেই কর্মরত। নাজিয়া ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজ থেকে বিজ্ঞানে পাস করেছে। তার ইচ্ছা চিকিৎসক হবে। নূরুল হাসান বললেন, মেয়েকে নিয়ে আসার জন্য আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়েছেন। প্রথম আলোর এ আয়োজন তাঁর কাছে খুব ভালো মনে হয়েছে। সুন্দর–সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা। তাঁর মেয়ের মতো সবাই খুব আনন্দ করছে। এ ধরনের আয়োজন শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করবে বলেই তিনি মনে করেন।
ফ্যান্টাসি কিংডমের ভেতরে এখন কৃতী শিক্ষার্থী আর তাদের অভিভাবকদের সমাগমে প্রাণবন্ত পরিবেশ। ঋতুর দিনগণনায় বসন্ত না এলেও পলাশ ফুলে ভরে গেছে ভেতরে ঐতিহ্য চত্বরের পলাশগাছ। তার তলা দিয়ে শিক্ষার্থীরা সরি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সনদ আর খাবার সংগ্রহের জন্য। এখানেই কথা হলো লতিফা বেগমের সঙ্গে। মেয়ে সিদরাতুল মুনতাহকে নিয়ে এসেছেন তিনি। বাসা শান্তিবাগ। বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ স্কুল ও কলেজে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী মুনতাহা। তার ইচ্ছা বিসিএস দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে যাবে।
মুনতাহার খুব ইচ্ছা ছিল এই উৎসবে আসার। কারণ, তার বড় দুই বোনও আগে জিপিএ-৫ সংবর্ধনায় এসেছেন। মুনতাহার মা জানান, এবার তাঁর শেষবারের মতো এই অনুষ্ঠানে আসা। এর আগে ২০০৮ সালে এসেছিলেন মুনতাহার বড় দুই যমজ বোন মৌ আর মিষ্টিকে নিয়ে। ওরা ভিকারুননিসা নূন স্কুলে পড়ত। মৌ চিকিৎসক হয়ে এখন কানাডাপ্রবাসী আর মিষ্টি বিবিএ পাস করে লন্ডনপ্রবাসী। বিয়ে হয়ে গেছে দুজনেরই। এই উৎসব খুব ভালো লাগে, তাই ছোট মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছেন।
ঐতিহ্য চত্বরের পাশেই প্রথম আলো পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের বুথ। সেখান থেকে বিশেষ প্যাকেজে কিশোর আলো ও বিজ্ঞানচিন্তা—এই দুটি ম্যাগাজিন দেওয়া হচ্ছে ছয় মাস ও এক বছরের জন্য। এতে ছয় মাসের প্যাকেজে নিলে পাওয়া যাবে সাত মাসের ম্যাগাজিন এবং এক বছরের প্যাকেজে পাওয়া যাবে ১৪ মাসের ম্যাগাজিন। মণিপুর স্কুলের জোয়ারদার সাকিরুল নবী ও তার চাচাতো ভাই জোয়ারদার আবু রাইয়ান উৎসবে এসে বিজ্ঞানচিন্তার এক বছরের প্যাকেজটি নিয়েছে। তারা জানাল, বিজ্ঞানচিন্তার তারা নিয়মিত গ্রাহক। এখানে প্যাকেজে সুবিধা থাকায় এক বছরের টাকায় ১৪ মাসের ম্যাগাজিন পাওয়া যাচ্ছে। তাই এই সুযোগ তারা হাতছাড়া করেনি।
ম্যাগাজিন ছাড়া বাসায় নিয়মিত প্রথম আলো বা ম্যাগাজিন রাখতে চাইলে এখানে নাম–ঠিকানা নিবন্ধন করার সুযোগ রয়েছে। এতে বাসায় নিয়মিত পত্রিকার বা ম্যাগাজিন সরবরাহের ব্যবস্থা করা হবে বলে বুথের কর্মীরা জানালেন।
আজ প্রথম দিনের সংবর্ধনায় আলোচক থাকবেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভিনসেন্ট চ্যাং, বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ ও শিখোর সহপ্রতিষ্ঠাতা জিসান কিবরিয়া। বক্তব্য দেবেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও কথাশিল্পী আনিসুল হক। সঞ্চালনা করবেন সহযোগী সম্পাদক সুমনা শারমীন।
পরে শিক্ষার্থীদের গানে গাতে মাতাবেন জলের গানের শিল্পীরা। একক শিল্পীদের মধ্যে থাকবেন ইমরান মাহমুদুল, পান্থ কানাই, দিনাত জাহান মুন্নী ও অনিমেষ রায়। মঞ্চ আলোকিত করতে আসবেন রুপালি পর্দার তারকা নায়ক ফেরদৌস আহমেদ, আফরান নিশো ও মেহজাবীন চৌধুরী।
দ্বিতীয় দিনের উৎসব
কাল মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানও ফ্যান্টাসি কিংডমেই শুরু হবে সকাল আটটায়। অতিথি থাকবেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভীন হাসান, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ ও শিখো সহপ্রতিষ্ঠাতা জিসান জাকারিয়া।
সংস্কৃতি পর্বে মঞ্চ মাতাবেন ব্যান্ডদল চিরকুট, আরিফিন শুভ, আফরান মৃধা, কোনাল, ঋতুরাজ, নন্দিতা, আফসান আরা বিন্দু ও অবন্তী সিঁথি।