রমজানে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পানির সংকট
রোজার শুরু থেকেই গরম বাড়তে শুরু করেছে। এই সময়ে রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে মালিবাগ, গুলবাগ, শেওড়াপাড়া, লালবাগ, রায়েরবাগ ও দক্ষিণখান এলাকায় সমস্যা বেশি। ফলে রমজান মাসে পানির কষ্টে পড়েছেন এসব এলাকার বাসিন্দারা। তবে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলছে, সার্বিকভাবে পানি সরবরাহে ঘাটতি নেই, এলাকাভিত্তিক কিছু সমস্যা রয়েছে।
ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় কিছু জায়গায় গভীর নলকূপে উৎপাদন কমেছে। রমজানে পানির চাহিদা বেড়ে যাওয়া এবং কয়েকটি এলাকায় চাহিদার তুলনায় গভীর নলকূপ কম থাকায় সমস্যা হচ্ছে। এবার মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে রমজান মাস শুরু হওয়ায় পানির সংকট তীব্র হয়নি। গরম মাত্র বাড়তে শুরু করেছে, সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে পানির সংকট বেশি হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন লালবাগের নবাবগঞ্জ লেন, আবদুল আজিজ লেন, ললিত মোহন দাস লেনসহ আশপাশের কিছু এলাকায় রোজার শুরু থেকে ওয়াসার পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মকবুল হোসেনের বাসা আবদুল আজিজ লেনে। তিনি আজ রোববার প্রথম আলোকে বলেন, রোজার শুরু থেকে এলাকায় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। ভোগান্তিতে পড়েছেন রোজাদার এলাকাবাসী। এ বিষয়ে ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
লালবাগ ঢাকা ওয়াসার মডস জোন-২–এর (আঞ্চলিক কার্যালয়) আওতাধীন। এই জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘লালবাগ এলাকায় ওয়াসার একটি গভীর নলকূপ বন্ধ ছিল। ফলে পানি উত্তোলনের পরিমাণ কমে যায়। ওয়াসার কারিগরি দল নলকূপটি ঠিক করেছে। আশা করছি, সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে।’
রোজার শুরু থেকেই শেওড়াপাড়া এলাকায় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। শেওড়াপাড়া এলাকার শাপলা সরণির বাসিন্দা মোখলেসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাঁচতলা ভবন। নয়টি পরিবার থাকে।
দৈনিক গড়ে এক গাড়ি পানি দিয়ে কাজ সারছি। তবে সব সময় সিরিয়াল দিয়েও ওয়াসার গাড়ি পাওয়া যায় না। তিন দিন আগে ২৯ নম্বর সিরিয়াল ছিল, কিন্তু পাইনি। বালতি দিয়ে ওপরের তলায় পানি উঠিয়ে চলতে হয়। এভাবে এক দিন, দুই দিন সম্ভব, রোজার মধ্যে প্রতিদিন তো করা যায় না।’
শামীম সরণিতেই ওয়াসার দক্ষিণ-পশ্চিম শেওড়াপাড়া পানির পাম্প অবস্থিত। রমজান মাস শুরুর আগের দিন এই গভীর নলকূপটি নষ্ট হয়। ফলে পুরো শেওড়াপাড়ায় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নলকূপটি মেরামতের কাজ চলছে। আজ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দেখা যায়, কয়েকজন শ্রমিক নলকূপ সংস্কারের কাজ করছেন।
নলকূপ সংস্কারের কাজ দেখভাল করছেন আরবান সার্ভিস নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কারিগরি পরামর্শক খোরশেদ আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নষ্ট নলকূপ ঠিক হতে আরও সাত থেকে আট দিন লাগবে। আর এখানকার সচল আরেকটি নলকূপে আগে প্রতি মিনিটে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার লিটার পানি উঠত। এখন আসছে ১ হাজার ১০০ লিটার।
ঢাকা ওয়াসার ১০টি মডস জোনে পানির গাড়ির চাহিদা জানানো হলে গাড়িতে করে পানি বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়। ঢাকা ওয়াসার প্রতিটি ছয় হাজার লিটারের বড় গাড়ির পানির দাম ৬০০ টাকা। তবে শেওড়াপাড়া এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, পানির গাড়ির জন্য সিরিয়াল দেওয়া হলেও নির্ধারিত সময়ে গাড়ি পাওয়া যায় না। আবার নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত অর্থও দিতে হয়।
বেশ কয়েক দিন ধরে মালিবাগ ও গুলবাগ এলাকাতেও পানির সমস্যা চলছে। এর মধ্যে রোজা শুরু হওয়ায় বাসিন্দাদের ভোগান্তি বেশি হচ্ছে। এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মালিবাগের মারুফ মার্কেট এলাকায় অবস্থিত ওয়াসার একটি গভীর নলকূপে সমস্যা হওয়ায় এই সংকট দেখা দিয়েছে।
ওয়াসার পরিচালন শাখা সূত্র জানা যায়, মিরপুর–৬ নম্বর সেকশনের ‘ট’ ব্লক, আগারগাঁও, রায়েরবাগ, নামা শ্যামপুর, মোহাম্মদবাগ, আজমপুর, কুড়িলের একাংশ ও ভাটারা এলাকাতেও পানির সমস্যা রয়েছে।
পানিসংকটের বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম সহিদ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সার্বিকভাবে ঢাকায় পানির সংকট নেই। কিছু জায়গায় সাময়িক সমস্যা হচ্ছে। মালিবাগ ও শেওড়াপাড়া গভীর নলকূপ মেরামতের কাজ চলছে। রোজার সময় পানি সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে সায়েদাবাদ পানি শোধনাগারের উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। কিছু স্ট্যান্ডবাই (জরুরি মুহূর্তে ব্যবহার উপযোগী) পাম্প চালু করা হয়েছে। যেখানে সমস্যা হচ্ছে, সেখানে ‘রেশনিং’ করে পানি দেওয়া হচ্ছে।
ঢাকা ওয়াসার দাবি, ঢাকায় পানির যে চাহিদা, উৎপাদন তার চেয়ে বেশি। ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় বর্তমানে পানির চাহিদা দৈনিক গড়ে ২৬০ কোটি লিটার। ওয়াসার উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ২৯০ কোটি লিটার পানি। কিন্তু সব এলাকায় ‘রেশনিং’ করার ব্যবস্থা না থাকায় কিছু জায়গায় সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এক এলাকায় পানির সংকট দেখা দিলে বা গভীর নলকূপ নষ্ট হলে আশপাশের এলাকা থেকে পানি এনে চাহিদা মেটানো হয়। একে ‘রেশনিং’ বলা হয়।
ওয়াসার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কোনো এলাকায় পানির সমস্যা হলে ঢাকা ওয়াসার হটলাইন নম্বর ১৬১৬২-এ যোগাযোগ করতে হবে। ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পানির সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা করা হবে।
প্রতিবছরই গ্রীষ্মে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পানির সংকট দেখা দেয়। এর বড় কারণ ভূগর্ভস্থ উৎসের ওপর নির্ভরতা। ২০১০ সালে ঢাকা ওয়াসার উৎপাদিত পানির ৮০ শতাংশ ছিল ভূগর্ভস্থ উৎসের, যা গভীর নলকূপের মাধ্যমে তোলা হচ্ছে। আর ২০ শতাংশ ছিল ভূ-উপরিভাগের পানি। সংস্থাটি ২০২১ সালের মধ্যে ভূ-উপরিভাগের পানির উৎপাদন অন্তত ৭০ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দেয়। তবে এ লক্ষ্য অর্জন করা যায়নি। এখনো ওয়াসার দৈনিক উৎপাদিত পানির ৭০ শতাংশই ভূগর্ভস্থ উৎসের।
ঢাকা ওয়াসা পানির উৎসের টেকসই সমাধান করতে পারেনি বলে মন্তব্য করেন নগরবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গভীর নলকূপ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। প্রতিবছর পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, যা প্রকৃতি-পরিবেশের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে। নলকূপনির্ভরতা কমিয়ে ভূ-উপরিভাগের পানির উৎপাদন বাড়ানোয় জোর না দিলে সংকট কাটবে না।