ওয়াসায় কাজ করলেও যা সত্য তা তো বলতেই হবে

মোহাম্মদপুরে ওয়াসার একটি এটিএম পানির বুথের সামনে পানির জন্য অপেক্ষা করছেন এক ব্যক্তি
ছবি: মানসুরা হোসাইন

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ওয়াসার পানি সরবরাহের এটিএম বুথে কথা হচ্ছিল বুথের একজন নারী কর্মীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ওয়াসায় কাজ করলেও যা সত্য তা তো বলতেই হবে। আমার বাসার ওয়াসার লাইনের পানি লাল রঙের, দুর্গন্ধযুক্ত। ওই পানি ফুটিয়ে খাওয়ানোর পর আমার পাঁচ বছর বয়সী ছেলে ডায়রিয়া হয়ে প্রায় মারাই যাচ্ছিল।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই নারী কর্মী আরও বলেন, ‘এরপর থেকে আর আমরা ওয়াসার লাইনের পানি খাই না। ওই পানি আসলে ফুটিয়ে খাওয়ারও যোগ্য না। বুথে কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরার সময় এটিএম কার্ড ব্যবহার করে এখান থেকে পানি নিয়ে যাই। এখান থেকে প্রতি লিটার পানি কিনি ৪০ পয়সা দরে।’

এ বুথেই কথা হলো পানি নিতে আসা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে। একজন জানালেন, ওয়াসার লাইনে লালচে পানিও আসছে না দুদিন ধরে। তাই কার্ডে পানি নিতে এসেছেন।

মোহাম্মদপুরের শেখেরটেক ৩ নম্বর সড়কে ওয়াসার পানি/পয়োলাইনের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছে—সাইনবোর্ড লাগিয়ে কয়েক দিন ধরে কাজ চলছে। সেখানকার ছবি তুলতে গেলে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা পানি পাই না, আর লাইনের বাইরে সব পানি বের হয়ে যাচ্ছে। এই হচ্ছে ওয়াসার পানির অবস্থা।’

রাজধানীবাসী বিভিন্ন সময় পানি পাচ্ছেন না, পানির মান নিয়েও ক্ষোভের অন্ত নেই। তাই পানির দাম বাড়ানো নিয়েও মানুষের গলায় ক্ষোভের আঁচ।

ঢাকা ওয়াসার অনিয়ম-দুর্নীতি ও গ্রাহক সেবার বিভিন্ন ঘাটতির দিক নিয়ে ২০১৯ সালে ‘ঢাকা ওয়াসা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তাতে বলা হয়, ঢাকা ওয়াসা পাইপলাইনের মাধ্যমে সুপেয় পানি সরবরাহ করতে ব্যর্থ। ৯১ শতাংশ গ্রাহক খাবার পানি ফুটিয়ে পান করেন। পানি ফুটিয়ে পানের উপযোগী করতে বছরে ৩২২ কোটি টাকার গ্যাস খরচ হয়।

এটিএম বুথ থেকে পানি নিচ্ছেন একজন
ছবি: প্রথম আলো

আজ বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, আবাসিক ও বাণিজ্যিক পর্যায়ে পানির দাম ৫ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে ঢাকা ওয়াসা বোর্ড। আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার কথা। কিন্তু বোর্ডের সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট নয় ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। আবাসিকে ২৫ শতাংশ ও বাণিজ্যিক সংযোগে ১৯ শতাংশ পর্যন্ত পানির দাম বাড়াতে চায় তারা। এ জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রস্তাব পাঠিয়েছে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। সব মিলিয়ে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৪ বছরে ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বেড়েছে ১৫ বার।

সর্বশেষ গত ৬ জুলাই ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের সভায় পানির দাম ৫ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। উৎপাদন ও পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধির যুক্তি দেখিয়ে তখনই পানির দাম ২০ শতাংশ বাড়ানোর পক্ষে ছিলেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান।

‘পানির দাম ২৫% বাড়াতে চায় ঢাকা ওয়াসা’ শিরোনামে প্রথম আলোর প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার আবাসিক গ্রাহকদের প্রতি ১ হাজার লিটার পানির জন্য দাম দিতে হয় ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। ওয়াসার নতুন প্রস্তাব কার্যকর হলে ১ হাজার লিটার পানির জন্য ১৯ টাকা খরচ করতে হবে। অন্যদিকে বাণিজ্যিক সংযোগের ক্ষেত্রে প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম বর্তমানে ৪২ টাকা। ওয়াসার নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী, বাণিজ্যিক সংযোগে পানির দাম দিতে হবে ৫০ টাকা।

করোনা মহামারির মধ্যেও ঢাকা ওয়াসা গত দুই বছরে পানির দাম ৩১ শতাংশ বাড়িয়েছে। ওয়াসার পানির দাম আরও বাড়তে পারে এমন প্রসঙ্গে আজ কথা হয় কল্যাণপুর এলাকার বাসিন্দা সাইফুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘জ্বালানির দাম বাড়ার পর থেকে জেনারেটর বন্ধ রাখা হয়েছে। আগামী মাসে পানির দামও বাড়বে। পানির বিল, জেনারেটর ও দারোয়ানের (নিরাপত্তারক্ষী) বেতন হিসেবে ফ্ল্যাটপ্রতি মাসিক ৩ হাজার টাকা সার্ভিস চার্জ নেওয়া হতো। আগামী মাস থেকে এটা বাড়ানো হবে বলে জানানো হয়েছে।’

মোহাম্মদপুরের শেখেরটেক ৩ নম্বর সড়কে চলছে ওয়াসার কাজ
ছবি: প্রথম আলো

উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা আতিকুর রহমানও প্রথম আলোকে বলেন, সিঁড়ি ঝাড়ু দেওয়া ও পানির বিল বাবদ ৯০০ টাকা নেওয়া হতো। পানির দাম বাড়ছে, তাই আগামী মাস থেকে ১ হাজার টাকা দিতে বলেছেন বাড়িওয়ালা।

তবে মোহাম্মদপুরের একটি বাড়ির কেয়ারটেকার (তত্ত্বাবধায়ক) আবদুর রাজ্জাক জানালেন, ২২টি ফ্ল্যাটে পানির বিল বাবদ ফ্ল্যাটপ্রতি ৮০০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। এটি বাড়ানোর কথা বাড়িমালিক এখনো জানাননি।

আরও পড়ুন

ফকিরাপুলের একজন বাড়িমালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আসলে মোট কত টাকার পানির বিল আসে, তা না জানলেও চলে। ওয়াসার লাইনম্যান পানির বিলের একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক বলেন। ওই পরিমাণ টাকা তাঁকে দিলে কিছু টাকা লাইনম্যানের পকেটে যায় আর কিছু টাকা তিনি জমা দেন। তবে পানির দাম বাড়লে এই নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার সংখ্যাও বাড়িয়ে দেবেন লাইনম্যান। এমনিতেই তেল, গ্যাসের দাম বেড়েছে। এখন পানির দামও এক লাফে এত বেশি বাড়লে তা জীবনযাত্রায় প্রভাব তো ফেলবেই।

রাজধানীতে ভাড়া বাসায় থাকেন এমন একাধিক ব্যক্তি জানালেন, সিকিউরিটি, পানি ও অন্যান্য বিল বাবদ বাড়িওয়ালারা একসঙ্গে টাকা নিচ্ছেন। এলাকাভেদে কোথাও পানির বিল বাবদ মাসে ৫০০ টাকা আবার কোথাও ৮০০ বা ১০০০ হাজার টাকা রাখা হচ্ছে। পানির দাম বাড়লে এ টাকার পরিমাণও বাড়িয়ে দেবেন বাড়িওয়ালারা। তাই বাড়তি এ টাকাটা তো ভাড়াটেকে নিজের পকেট থেকেই দিতে হবে।

আরও পড়ুন

আবাসিক ও বাণিজ্যিক সংযোগে পানির দাম বাড়াতে চাওয়া প্রসঙ্গে ৪ আগস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। এতে বলা হয়, পরিচালনা ব্যয় ও বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের টাকার (ডিএসএল) পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান পানির দামে ওয়াসার পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং ডিএসএল পরিশোধ দুরূহ হয়ে পড়েছে। ঋণের টাকা পরিশোধ ও ব্যয়ভার বহন করতে পানির বিশেষ মূল্যবৃদ্ধি প্রয়োজন। তবে বস্তি এলাকার বাসিন্দাদের জন্য দাম অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব দিয়েছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।