কী সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো

বুড়িগঙ্গার বুকে নৌকায় ভেসে চাঁদ দেখা। শিল্পীর চোখে।

ষাট ও সত্তর দশকে বাকল্যান্ড বাঁধ বা বুড়িগঙ্গার বুকে নৌকায় ভেসে চাঁদ দেখার মধ্য দিয়ে শুরু হতো রোজার প্রস্তুতি। নদীর পাড়ে চাঁদ দেখার জন্য বিকেল থেকে ভিড় জমত উৎসুক জনতার। চাঁদ দেখার আনন্দে আমিও চলে যেতাম সেই ভিড়ের মধ্যে। যাদের বাড়ি নদী থেকে দূরে, তারা যেত লালবাগ কেল্লায় বা উঁচু ভবনে চাঁদ দেখতে। এভাবে চাঁদ দেখার উৎসব দিয়ে শুরু হতো পবিত্র রমজানের সূচনা।

সেকালে কাসিদা গেয়ে মহল্লায় মহল্লায় ঘুরে সাহ্‌রির জন্য ঘুম ভাঙাতেন কাসিদা দলের সদস্যরা। সংগীতের মৃদু বাজনা আর ভোররাতের বুড়িগঙ্গার মৃদুমন্দ হাওয়া পবিত্র পরিবেশের সৃষ্টি করত পুরান ঢাকার আকাশে-বাতাসে। আজও যেন আমার কানে ভেসে উঠে সেই কাসিদার সুর।

বিত্তবান পরিবার থেকে প্রতিদিন মসজিদে ইফতারি পাঠানোর রেওয়াজ ছিল। গরিব, মুসাফির ও মুসল্লিদের ইফতার ও রাতের খাওয়া হতো মহল্লার মানুষদের পাঠানো খাবারে। এ ছাড়া পঞ্চায়েতের সরদারেরা নিজ উদ্যোগে মসজিদে ইফতারি পাঠাতেন।

ইফতার অধিকাংশই বাসাবাড়িতে তৈরি হতো। আসরের নামাজের পর থেকেই বাড়িতে বাড়িতে পড়ে যেত ইফতারি বানানোর ধুম।

তখনো চকবাজারের ইফতারি কম জনপ্রিয় ছিল না। কিন্তু সেসব কিনত মানুষ শখ করে। আত্মীয়ের বাড়িতে ইফতারি পাঠানো বা কারও বাড়িতে দাওয়াত খেতে যাওয়ার সময় চকবাজার থেকে ইফতারি কিনে নিয়ে যাওয়া হতো। ইফতারের সময় ঘোষণা করে বাজানো হতো সাইরেন। সূত্রাপুর থানা, মিলব্যারাক, ঢাকা জুটমিলে সাইরেন ছিল। তখন রেস্তোরাঁয় বসে সাহ্‌রি ও ইফতার খাওয়ার কথা ভাবাও অসম্ভব ছিল।

ঢাকার প্রথম রেস্তোরাঁগুলোর মধ্যে একটি ছিল ব্রিটিশ আমলে তৈরি ‘ওকে’ রেস্তোরাঁ। পাকিস্তান আমলে এর নাম হয় ‘মাই রেন্ডার রেস্টুরেন্ট’। ন্যাশনাল হাসপাতাল জায়গাটি কিনে নেওয়ার পর এখন আর সে খাবারের দোকানের চিহ্ন নেই। আল রাজ্জাকের মতো হোটেলের প্রচলন স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে।

কাবাবের জন্য পুরান ঢাকা বিখ্যাত হলেও চকবাজারের কিছু কাবাব আসলে পুরান ঢাকার ঐতিহ্য নয়। যেমন বট কাবাব আমদানি হয়েছে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে। দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গ থেকে মোহাজেররা আসায় তাঁদের সংস্কৃতি মিশে গেছে আদি ঢাকার খাবারের সঙ্গে। চকবাজারের ইফতারে ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ নামের যে খাবারটি নিয়ে খুব আগ্রহ আলোচনা, সেটি আসলে দু-তিন দশক আগেও ছিল না।

২০ রমজানের পর থেকেই সদরঘাট জমজমাট হয়ে উঠত বেচাকেনায়। সারা রাত খোলা থাকত দোকানপাট। এমনকি ঈদের দিন সকাল পর্যন্ত। সবশেষে ঈদের বাজার করতেন দোকানিরা। দু-চারটে বনেদি টেইলর হাউস ছিল ইসলামপুরে। ঈদের ১৫ দিন আগেই খলিফারা আমাদের বাড়িতে এসে মাপ নিয়ে যেতেন। এরপর প্রায়ই গিয়ে আমরা তাঁদের তাগাদা দিয়ে আসতাম, বলতে গেলে বেচারাদের ঘুমই হারাম হয়ে যেত।

ঈদের আগের রাতে চাঁদ দেখা ছিল অত্যন্ত আনন্দের ব্যাপার। উঁচু গাছে বা উঁচু মিনারে চড়ে, বাড়ির ছাদে উঠে, যে যেখান থেকে পারত, চাঁদ দেখার চেষ্টা করত। চাঁদ দেখতে পেলেই সে যে কী উল্লাস, আহা! কী সুন্দর ছিল সেই সোনালি দিনগুলো। মসজিদ থেকে ঘোষণা দিয়ে ঈদের আগাম শুভেচ্ছা জানানো হতো, সঙ্গে জানিয়ে দেওয়া হতো ঈদের জামাতের সময়। চাঁদরাতে মসজিদ ধোয়াও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল মহল্লাবাসীর। তখনো এত পানির ব্যবস্থা না থাকায় কুয়ো থাকত মসজিদসংলগ্ন। মুয়াজ্জিনের সঙ্গে আমরা মহল্লার কিশোর–যুবকেরা মসজিদ ধোয়ার কাজ করতাম।

ঈদের দিন সকালে সেমাই বা মিষ্টান্নজাতীয় খাবার খেয়ে বাবার হাত ধরে চলে যেতাম ঈদের জামাতে এক টাকার রংবেরঙের কাগজের টুপি মাথায় দিয়ে। যেটা কিনা একবারই ব্যবহার করা যেত। আমাদের ঈদ যে খুব জমকালো ছিল, তা নয়, কিন্তু আনন্দদায়ক ছিল। বাড়িতে বাড়িতে বানানো হতো নানা ধরনের সেমাই, পিঠা–পায়েস। চুটকি আর চই সেমাই ছিল বিখ্যাত।

নামাজ থেকে ফিরে খেতাম ‘ল্যাটকা খিচুড়ি’ আর কুমড়া দিয়ে গরুর গোশত। পোলাও, কোরমার আয়োজন হতো দুপুর ও রাতে। ঈদের দিনে ১০-১৫ লিটার পেস্তার শরবত তৈরি করা হতো।

কাচের সোরাহিতে রাখা জাফরান মেশানো এ শরবত পরিবেশন করা হতো ছোট ছোট কাচের গ্লাসে। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা থাকত সরদার বাড়িতে। সারা দিন চলত বিভিন্ন ধরনের সেমাই, পিঠা–পায়েস ও পেস্তার শরবত।

ঈদের সালামি বা ঈদি তো ঈদের আরেকটি বড় ব্যাপার। যেখানে বেশি সালামি, সেখানে আগে পৌঁছানোর সে কী প্রতিযোগিতা ছিল আমাদের মধ্যে। পাঁচ টাকা ঈদি পেলেই যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতাম। সে সময় এটাই ছিল অনেক টাকা। মায়ের কাছে এনে জমা রাখতাম।

ঈদের সময় শাসনে কোনো কড়াকড়ি ছিল না। বড়রা খুব মায়া-স্নেহ করতেন। এককথায় বলতে গেলে আমার ছোটবেলার ঈদ ছিল অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ।

  • মোহাম্মদ আজিম বখ্শ, সমাজসেবী ও পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জ মহল্লার সরদার মাওলা বখ্‌শের ছেলে।