বিশ্রামাগার থেকে মর্গে ঠাঁই হলো তাঁদের

আবদুল ওহাব
ছবি: সংগৃহীত

বরিশাল হোটেলের কারিগর আবদুল ওহাব ওরফে ওসমান। ১২ ঘণ্টার পালার কাজ যখন তাঁর শেষ হয়, তখন বেলা ১১টা। এরপর বিশ্রামের জন্য হোটেলটির দোতলায় উঠে যান। এর ৩০ থেকে ৪৫ মিনিটের মাথায় হঠাৎ আগুন ধরে যায় হোটেলে। অনেকে বের হতে পারলেও ওহাব পারেননি। এখন তাঁর মরদেহ আছে পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে।

শুধু ওহাবই নন, তাঁর মতো হোটেলের আরও পাঁচজন এই আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। সবাই রাতের পালার(রাত ১১ থেকে সকাল ১১টা) কাজ শেষ করে ওপরতলায় ঘুমাতে গিয়েছিলেন। রাজধানীর চকবাজারের দেবীদাস ঘাট লেনে আজ সোমবার বেলা ১১টার দিকে হোটেলটিতে আগুন লাগে। মুহূর্তেই তা তিনতলা ভবনটিতে ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় তিনতলায় প্লাস্টিক কারখানায় তেমন শ্রমিক ছিলেন না। আর যাঁরা ছিলেন, তাঁরা বের হয়ে আসতে পেরেছিলেন। পরে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট প্রায় আড়াই ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। এরপর দোতলার সেই বিশ্রামাগার থেকে এক এক করে ছয়জনের মরদেহ পাওয়া যায়।

ওহাব যখন বিশ্রামে যান, তখন তাঁর চাচাতো ভাই নান্টু মিয়া হোটেলের নিচতলায় কাজ করছিলেন। নিচতলায় থাকায় সহজেই বের হতে পারায় আগুন থেকে বেঁচে যান তিনি। নান্টু মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি দৌড়ে হোটেল থেকে বের হই। তখন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে।’

ওহাবের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে। তাঁর বড় ভাই আবদুল ওয়াহিদও ধানমন্ডির একটি রেস্টুরেন্টে ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নান্টুর কাছ থেকে আগুনের খবর পেয়ে ছুটে আসেন। এর মধ্যে ওহাবের মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়ে বারবারই বন্ধ পান। পরে ওয়াহিদ খবর পান, হোটেল থেকে কয়েকজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আবার ভাইয়ের খোঁজে ছুটে আসেন মিটফোর্ড হাসপাতালে। তাঁর চোখের সামনে তখন পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া ছোট ভাই।

আবদুল ওয়াহিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের মা যখন মারা যান, তখন ওহাব অনেক ছোট। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে সে। এরপর অভাবের সংসারে আর লেখাপড়া এগোয়নি। ১৫ বছর আগে ঢাকায় আসে ওহাব। ওর স্বপ্ন ছিল, একটি হোটেল দেবে। এ নিয়ে আমার সঙ্গে বহুবার কথা বলেছে। কিন্তু এর জন্য যে টাকা দরকার, তা ছিল না। তবে বলত, “ভাই, আমি একদিন ঠিকই হোটেলের মালিক হব।” আমার ছোট ভাইটির স্বপ্ন আর পূরণ হলো না।’

আর বিদেশে যেতে হবে না স্বপনকে

স্বপন সরকার
ছবি: সংগৃহীত

হবিগঞ্জের তরুণ স্বপন সরকার বরিশাল হোটেলে কারিগর হিসেবে কাজে যোগ দেন গত মাসের শেষ সপ্তাহে। স্বপনের স্বপ্ন ছিল, বিদেশে গিয়ে অভাবের সংসারে গতি ফেরাবেন। ওমানে যাওয়ার জন্য বছর দেড়েক আগে থেকে চেষ্টা–তদবির করেন। পাসপোর্টও করেন।

হোটেলের আগুন লাগার খবর দুপুরে পান বড় ভাই সজল সরকার। তিনিও ঢাকায় থাকেন। ভাইকে বারবার ফোন দিয়ে মুঠোফোন বন্ধ পাচ্ছিলেন। তাই যতটা দ্রুত সম্ভব চকবাজার চলে আসেন। পরে জানতে পারেন, আগুনে পুড়ে যে ছয়জন মারা গেছেন, তাঁদের একজন স্বপন। মিটফোর্ড হাসপাতালে ভাইয়ের মরদেহ দেখার পর চিৎকার করে কাঁদছিলেন সজল। তিনি বলছিলেন, ‘ভাই রে, তুই কোথায় গেলি? ওমানে কে যাবে? তোর ভিসা এসেছে।’

আর কথা বলবেন না বিল্লাল

বিল্লাল সরদার
ছবি: সংগৃহীত

বরিশালের বিল্লাল সরদার (৩৫) জীবনের ২০ থেকে ২২ বছর কেটেছে হোটেলে। হোটেলে টেবিলে টেবিলে খাবার পরিবেশন করতেন তিনি। এই কাজ করে যা আয় করতেন, তার সিংহভাগই পাঠিয়ে দিতেন স্ত্রীর কাছে। বিল্লালের স্ত্রীর সুমাইয়া দুই ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে গ্রামে থাকেন। মাত্র চার দিন আগে বরিশাল থেকে ঘুরে ঢাকায় আসেন বিল্লাল। তাঁর স্ত্রীর বড় ভাই জিয়াউদ্দিন ঢাকার একটি বেসরকারি টেলিভিশনের ক্যানটিনে কাজ করেন। বেলা দুইটার দিকে খবর পান, ভগ্নিপতি বিল্লালের হোটেলে আগুন লেগেছে। ছুটে আসেন সেখানে। পরে জিয়াউদ্দিনই ভগ্নিপতির মরদেহ শনাক্ত করেন। তবে বোনকে এখানো মৃত্যুর খবর জানাননি জিয়াউদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বোনের পরিবারটি পথে বসে গেল।’

একইভাবে বরিশাল হোটেলের আগুনে পুড়ে জীবনযুদ্ধ থেমে গেছে নোয়াখালীর রুবেলের (৩৫), বরিশালের মোতালেব (১৬) ও কুমিল্লার শরীফের (১৬)।

কিশোর শরীফের খালা নাসরিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বোনের স্বামী অসুস্থ হয়ে বিছানায়। অভাবের সংসারে কোনো উপায় না পেয়ে ১৫ দিন আগে এই হোটেলে কাজ নিয়েছিল সে।’ ছেলের মৃত্যুসংবাদ শুনে মা ফাহিমা পাগলপ্রায় বলে জানালেন নাসরিন।

মর্গের সামনে স্বজনদের ভিড়
ছবি: প্রথম আলো

ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বরিশাল হোটেলের সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাত। আমরা হোটেলমালিক ফখরুদ্দিনকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছি।’