ঢাকায় পানি ছিটিয়ে বায়ুদূষণ কতটুকু কমছে

বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান আইকিউয়ের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ১৫ দিন ধরে ঢাকার বায়ু অস্বাস্থ্যকর।

ঢাকার বায়ুদূষণ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানি ছিটিয়ে চলছে দূষণ কমানোর চেষ্টা
ফাইল ছবি

মার্চ মাসের অর্ধেক চলে গেছে। এই সময়ে প্রতিদিন রাজধানী ঢাকার বায়ু ছিল মানুষের বসবাসের জন্য অস্বাস্থ্যকর। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার দূষিত বাতাসের শহরের তালিকা প্রকাশ করে। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বায়ুর অবস্থা এমনই।

এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন পানি ছিটানোর কাজ করেছে। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, পানি ছিটানোর পরপর দূষণ কিছুটা কমে। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আবার তা আগের অবস্থায় ফিরে যায়। গত ফেব্রুয়ারিতে এ গবেষণা করেছে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)।

সাম্প্রতিক কালে ঢাকার বায়ুদূষণ বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইকিউ এয়ারের তথ্যমতে, ঢাকা বিশ্বের দূষিত নগরগুলোর একটি। প্রায়ই এটি তালিকার শীর্ষে থাকে। ফেব্রুয়ারির ২৮ দিনের মধ্যে এক দিনও ঢাকাবাসী নির্মল বায়ু পাননি।

এ মাসে ঢাকার বাতাস অস্বাস্থ্যকর ছিল ১০ দিন, খুবই অস্বাস্থ্যকর ১৫ দিন ও দুর্যোগপূর্ণ ছিল ৩ দিন। এর আগে গত জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক দিন দুর্যোগপূর্ণ বায়ুর মধ্যে কাটিয়েছে নগরবাসী। ওই মাসে ৯ দিন রাজধানীর বায়ুর মান দুর্যোগপূর্ণ ছিল, যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের বিষয়ে হাইকোর্ট ২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর শুকনো মৌসুমে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ দেন। নির্দেশ মেনে দুই সিটি পানি ছিটানো শুরু করে।

ক্যাপসের চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ‘গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্যস্ততম সড়কে পানি ছিটানোর আগে–পরে বায়ুদূষণের অবস্থা নির্ণয় করা। গবেষণায় বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২.৫) ও ক্ষুদ্র বস্তুকণার (পিএম ১০) উপস্থিতি দেখা হয়েছে।’

এই অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতির গ্রহণযোগ্য মান প্রতি ঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম আর ক্ষুদ্র বস্তুকণার ৫০ মাইক্রোগ্রাম। আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদারের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি গবেষক দল গবেষণাটি পরিচালনা করে। গবেষণায় ঢাকা শহরের মোট ১২ স্থানে জরিপকাজের জন্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়।

গবেষণার ফলাফল

গবেষণায় ১২টি স্থানের উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, পানি ছিটানোর আগে ক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে ১৫৯ মাইক্রোগ্রাম ও পানি ছিটানোর পরে ক্ষুদ্র বস্তুকণার গড় পরিমাণ ১০৬ মাইক্রোগ্রাম ছিল। অর্থাৎ শতকরা ৩৪ ভাগ কমে এবং বায়ুমান সূচকেরও উন্নতি হয়। যেখানে পানি ছিটানোর আগে বায়ুমান সূচক ছিল ‘সতর্কতামূলক’, পানি ছিটানোর পর সূচক হয়েছে ‘মধ্যম’। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর বায়ুদূষণ আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়।

আবার পানি ছিটিয়ে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি কমে ৩৩ শতাংশ; যদিও বায়ুমান সূচকের উন্নতি হয়নি। যেখানে পানি ছিটানোর আগে বায়ুমান সূচক ছিল ‘অস্বাস্থ্যকর’, সেখানে পানি ছিটানোর পরও সূচকের অবস্থান ‘অস্বাস্থ্যকর’ রয়ে গেছে।

আহমদ কামরুজ্জমান বলেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ব্যস্ততম সড়কে পানি ছিটানোর আগের চেয়ে পানি ছিটানোর পর বায়ুতে বস্তুকণার পরিমাণ তুলনামূলক কম দেখা গেলেও তা আশানুরূপ নয়।

দুই সিটি কতটা পানি ছিটায়

দুই সিটি করপোরেশন গাড়ি দিয়ে ওয়াসা থেকে নেওয়া পানি ছিটায়। উত্তর সিটির সহকারী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) ফজলে রাব্বীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১০টি গাড়ি দিয়ে ৩৭ ট্রিপের মাধ্যমে তারা পানি ছিটায়।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির পরিবহন কর্মকর্তা মো. গোলাম সারোয়ারের তথ্য অনুযায়ী, ৯টি গাড়ি দিয়ে ৩৫টি ট্রিপের মাধ্যমে পানি ছিটান তাঁরা। পানি দেওয়ার পর পরিস্থিতির কতটুকু উন্নতি হয়েছে, প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ধুলাবালু তো কমে। দূষণ কমে কি না, জানি না।’

দূষণ রোধ হবে কীভাবে

ক্যাপসের আরেক গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য সমন্বয়হীন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজ ৩০ ভাগ দায়ী। এ ছাড়া ইটভাটা ও শিল্পকারখানা ২৯, যানবাহন ১৫, আন্তদেশীয় বায়ুদূষণ ৯ দশমিক ৫, বাসাবাড়ি ও রান্না উৎস থেকে ৮ দশমিক ৫ এবং বর্জ্য পোড়ানোর ফলে ৮ ভাগ বায়ুদূষণ হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মো. আবদুস সালাম ঢাকার বায়ু পরিস্থিতি নিয়ে একাধিক গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, ‘পানি ছিটালে সাময়িকভাবে ধুলাবালু কিছুটা প্রশমিত হয়। কিন্তু ঢাকার বায়ুদূষণে যেসব উপাদান আছে, যেমন ইটভাটা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া—এসবের কোনো নিয়ন্ত্রণ চোখে পড়ে না। এ নিয়ে অনেক কথা শুনি, কিন্তু কাজের কিছু তো চোখে পড়ে না।’