বর্জ্যের টাকার ভাগ চান ঢাকা উত্তর সিটির কাউন্সিলররা

প্রত্যয়ন দিতে কাউন্সিলররা নানা অঙ্কের টাকা দাবি করেন। পরে আদালতের নির্দেশে প্রত্যয়ন ছাড়া দরপত্র জমা নেওয়া হয়।

প্রথম আলো ফাইল ছবি

ময়লা সংগ্রহের কাজ পেতে দরপত্রে অংশ নিতে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের প্রত্যয়ন লাগবে। বর্জ্য সংগ্রহকারী ভ্যান সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের জন্য এমনই শর্ত দিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ। গৃহস্থালির বর্জ্য সংগ্রহে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনসংক্রান্ত নীতিমালা বা টার্মস অব রেফারেন্সে (টিআর) এটি উল্লেখ করা হয়েছিল।

এই সুযোগে উত্তর সিটির অনেক ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কাজপ্রত্যাশী প্রতিষ্ঠান বা ঠিকাদারের কাছে প্রত্যয়নের বিনিময়ে এককালীন টাকা চেয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কেউ ‘শর্ত’ দিয়েছিলেন প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার ভাগ দেওয়ার। কোনো কোনো কাউন্সিলর তো বর্জ্যের কাজ করা আগের প্রতিষ্ঠানকে প্রত্যয়ন দেননি। দিয়েছেন নিজের ভাই, ছেলে কিংবা রাজনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের। এতে দরপত্র কিনেও তা আর জমা দিতে পারেননি অনেক ভ্যান সার্ভিস প্রতিষ্ঠান।

এ অবস্থায় ভ্যান সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের মালিকদের অনেকে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। পরে গত মঙ্গলবার আদালত নির্দেশনা দেন, প্রত্যয়ন ছাড়াই দরপত্র জমা নেওয়ার। অবশেষে দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন গতকাল রোববারে প্রত্যয়ন ছাড়াও দরপত্র জমা নেওয়া হয়।

ঢাকা উত্তর সিটির ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে (শংকর, রায়েরবাজার, জাফরাবাদ এলাকা) ১৯৯৭ সাল থেকে বর্জ্য সংগ্রহের কাজ করেন শান্তি রিবারু। দরপত্রে অংশ নিতে গ্রামীণ এন্টারপ্রাইজ নামে ট্রেড লাইসেন্স করেছেন। শান্তি রিবারু প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রত্যয়ন দেওয়া নিয়ে কাউন্সিলর মাছের বাজার বসিয়েছেন। এ বাবদ এককালীন ২০ লাখ এবং প্রতি মাসে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা দাবি করেছিলেন।’

এ–সংক্রান্ত একটি কথোপকথনের রেকর্ড এই প্রতিবেদককে দেওয়া হয়। তাতে কাউন্সিলর শেখ মোহাম্মদ হোসেন বলছেন, ‘এখন তো ওই যে ওরা, ওই ছেলে বলছে, ভাই আপনি ছয় মাসের চান, ছয় মাসের অ্যাডভান্স দিয়ে দিই, এক লাখ বাড়াই দিই।’ কারা জানতে চাইলে কাউন্সিলর বলেন, ‘মামুন ভাইরা। মামুন ভাই আমাকে রিকোয়েস্ট করছে। আমি বলছি, দেখেন এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’

অবশেষে কাজ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে কাউন্সিলরের সঙ্গে সমঝোতা করতে রাজি হন শান্তি রিবারু। সিদ্ধান্ত হয় যে কাউন্সিলরকে এককালীন প্রত্যয়ন নেওয়ার সময় ১০ লাখ টাকা দেবেন। কাজ পাওয়ার পর দিতে হবে ২ লাখ টাকা। আর প্রতি মাসে ৬ লাখ টাকা দিতে হবে।

শান্তি রিবারুর ভাষ্য, ‘নিরুপায় হয়ে রাজি হয়েছিলাম। পরে আবার ভাবলাম এককালীন টাকা হয়তো ধার নিয়েও দেওয়া যাবে। কিন্তু প্রতি মাসে যে টাকা দিতে হবে, সেটা কোথা থেকে দেব? তখন তো ময়লার বিল ৪০০-৫০০ টাকা করে নিতে হবে।’

পরে আদালতে মামলা করেন এবং আদালতের নির্দেশ পেয়ে প্রত্যয়ন ছাড়াই দরপত্র জমা দেন। তবে প্রত্যয়ন না নেওয়ায় গত শনিবার কাউন্সিলর ফোন করে কাজ কীভাবে তিনি পান সেটা দেখে নেবেন বলে হুমকি দেন।

এ বিষয়ে কাউন্সিলর শেখ মোহাম্মদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাউকেই প্রত্যয়ন দিইনি। ওনাদের বলেছিলাম সমন্বয় করতে। যেহেতু ৯টি বাড়িমালিক সমিতিও ময়লা নেওয়ার কাজ নিজেরা করে।’ তিনি কোনো জায়গা থেকে কোনো পয়সাপাতি নেন না বলে দাবি করেন তিনি।

একই ধরনের অভিযোগ উত্তর সিটির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের ভ্যান সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের মালিকদের। তাঁরা জানান, কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ প্রতি মাসে ২০ লাখ করে টাকা দাবি করেছিলেন। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেন কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ। উল্টো তিনি বলেন, বর্জ্য সংগ্রহকারীদের ৩৫ বছরের সাম্রাজ্য ভেঙে যাচ্ছে বলেই এখন তাঁরা এসব অভিযোগ করছেন।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শাখার কর্মকর্তারা জানান, বর্জ্য সংগ্রহের কাজের ২৬৪টি দরপত্র বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু জমা পড়েছে মাত্র ৮৩টি। তা–ও আদালতের ওই নির্দেশনা আসার পরে।

এ বিষয়ে জানতে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজাকে মুঠোফোনে কল দেওয়া হলে তিনি সাড়া দেননি। পরে প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমোডর এস এম শরিফ–উল ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তিনিও ফোন ধরেননি।