‘দুর্ঘটনার কথা সবাই ভুলে যায়, কিন্তু ভুক্তভোগীদের জীবন যায় থেমে’

‘সড়ক পরিবহন আইনে যাত্রীদের অধিকার চাই’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নেন রাহিদা আঞ্জুম। তাঁর বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন
ছবি: প্রথম আলো

‘সড়ক দুর্ঘটনার কিছুদিন পর সবাই এই ঘটনা ভুলে যায়। কিন্তু এই ঘটনায় ভুক্তভোগীদের জীবন থেমে যায়।’

কথাগুলো বলছিলেন বাসের ধাক্কায় নিহত আরশাদ হাসানের মেয়ে রাহিদা আঞ্জুম। তিনি স্নাতক শেষ করেছেন। তাঁর বাবা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। এই দুর্ঘটনার তাদের পরিবার বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে গেছে। আজ বুধবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে যাত্রী অধিকার দিবস ২০২৩ উপলক্ষে ‘সড়ক পরিবহন আইনে যাত্রীদের অধিকার চাই’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে রাহিলা এসব কথা বলেছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

গত ১৬ জুলাই মিরপুরের কালশী উড়ালসড়কের নিচ দিয়ে রাস্তা পারাপারের সময় আরশাদ হাসান বাসের ধাক্কায় নিহত হয়েছেন জানিয়েছেন তাঁর একমাত্র মেয়ে রাহিদা। তিনি বলছিলেন, ওই দিন সকাল নয়টার দিকে বাসের ধাক্কায় তাঁর বাবা ২৫ থেকে ৩০ ফুট দূরে গিয়ে পড়ে মারা যান। তাঁর বাবা একটি বুটিকস হাউসে কাজ করতেন। সংসারে তাঁর ছোট ভাই ও মা আছেন। বাবাকে হারিয়ে তাঁরা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন।

আর কেউ যাতে স্বজনহারা না হন, সে জন্য এ বিষয়ে কঠোর আইন বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানান রাহিদা।

গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‘দেশে বড় বড় অবকাঠামো হচ্ছে। বড় রাস্তা হচ্ছে, এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে। মেট্রোরেল হয়েছে। কিন্তু মানুষের জীবন রক্ষা করতে পারছি না। দুর্ঘটনা বন্ধ করতে সরকারের বড় দায়িত্ব রয়েছে। তবে নিজেদেরও সচেতন হতে হবে। ট্রাফিক আইন মানতে হবে।’

করোনা মহামারি সফলভাবে মোকাবিলা করা গেলেও সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে ব্যবস্থা না নেওয়ায় আক্ষেপ জানিয়ে কাজী রিয়াজুল হক বলেন, প্রতিদিন সড়কে ৬০ জন মানুষ মারা যাচ্ছেন। কত মায়ের বুক খালি হচ্ছে। এসব সহ্য করার মতো নয়।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সংসদ সদস্য লুৎফুন্নেছা খান বলেন, বাসের মালিকদের অনেকে রাজনৈতিক ও স্বনামধন্য ব্যক্তি। অনেকে সংসদ সদস্যও আছেন। কিন্তু তাঁরা সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে মাথা ঘামান না।

সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে টহল পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশ ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে কি না, তা দেখতে হবে উল্লেখ করে লুৎফুন্নেছা বলেন, জীবনের মূল্য অনেক বেশি। তাই রাস্তা পারাপারের সময় নিজেদেরও সতর্ক থাকতে হবে। চালকদের নিয়মিত ডোপ টেস্ট করানোর ব্যবস্থা করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

গোলটেবিল আলোচনায় ধারণাপত্র পাঠ করেন আয়োজন সংগঠনের মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, সরকার-পরিবহনমালিক-শ্রমিকসংগঠনগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ায় দেশের যাত্রীসাধারণ এখানে অসহায় হয়ে পড়েছেন। সরকারি শক্তিতে বলীয়ান হয়ে পরিবহনমালিকেরা ইচ্ছেমতো পরিবহন চালাতে গিয়ে এই সেক্টরে বিশৃঙ্খলা-অরাজকতা ব্যাপক হারে বাড়ছে।

মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, গত দেড় দশকে সড়কে যে হারে উন্নয়ন হয়েছে, সড়কে শৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনায় আমরা ততটা পিছিয়ে আছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, দেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় ২৪ হাজার ৯৫৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। দেশের যোগাযোগ সেক্টরে অবকাঠামো নির্মাণে লাখো কোটি টাকা ব্যয় হলেও বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের শহর ও শহরতলিতে যাতায়াতের জন্য মানসম্মত কোনো গণপরিবহন নেই। রাজধানীতে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ভাঙা, লক্কড়ঝক্কড় বাসে অস্বাভাবিক ভোগান্তি নিয়ে প্রায় সাড়ে চার কোটি ট্রিপ যাত্রীর যাতায়াত করতে হয়।