আফসানা দেখতে দু-তিন বছরের শিশুর মতো, আসলে বয়স ১৪

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতাল থেকে দেওয়া ব্যবস্থাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, আফসানার অসুখটি ‘হাইপো থাইরয়েড’
ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবীর সব শিশুর হাসি সুন্দর। চোখের তারা ঝলমল করে ওঠে বলে ছোট্ট আফসানা খাতুনের হাসিটা আরও সুন্দর। মন ভালো থাকলে সে হাসে। তবে সেই অভিব্যক্তি চট করে বোঝা যায় না। যেমন প্রথম দেখাতেই বোঝা যায় না ওর সত্যিকার বয়সটা। দু–তিন বছরের শিশুর মতো দেখতে আফসানা আসলে কিশোরী। এখন তার ১৪ চলছে।
সারা দিন ঘরে খাটের ওপর একা বসে থাকে আফসানা। ইশারায় বোঝায় নিজের প্রয়োজন। হাঁটতে-চলতে শেখেনি। মা কাজে গেলে তাকে সারা দিন বদ্ধ ঘরের খাটে বসেই সময় কাটাতে হয়। অভিমান জানানোর ভাষাও ওর নেই। ১৪ বছর বয়সেও কথা বলতে শেখেনি। ভারী জিহ্বাটা সব সময় মুখ থেকে বের হয়ে থাকে। আর এ জন্যই ওর হাসিটা বেশি স্পষ্ট হয় চোখের তারায়।

আফসানা জিহ্বার জন্য কথা বলতে পারে না। কী যে ওর ভালো লাগে আর কিসে কষ্ট হয়, তা প্রকাশ করতে পারে না। ধোঁয়া ওঠা ভাত আর গরম-গরম মাংসের তরকারি পেলে সবটা খেতে চায়। কষ্ট হলেও জিহ্বা মুখের ভেতর রাখতে চেষ্টা করে তখন। অসুস্থ মেয়েটির চিকিৎসা করানোরই সামর্থ্য নেই পরিবারের। তাকে রোজ রোজ পছন্দের খাবারের জোগান দেওয়ার কথা তো ভাবাও যায় না। মেয়ের কষ্ট আর নিজেদের অসহায়ত্বের কথা বলতে বলতে বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আফসানার মা রোজিনা বেগম।

আফসানার আরও তিন ভাইবোন আছে। তারা সবাই সুস্থ-স্বাভাবিক। বড় ভাই ইমরানের বয়স ২৩ বছর। আফসানা সবার ছোট। আট বছর আগে মেয়ের চিকিৎসার কথা ভেবেই পরিবারটি সোনাইমুড়ি থেকে চলে আসে রাজধানীতে। কিন্তু খরচ সংকুলান হয় না।

রাজধানীর মানিকনগরের বাসিন্দা জামাল হোসেন আর রোজিনা বেগমের ছোট মেয়ে আফসানা। বাবা রিকশা চালান। মা কাজ করেন বাসাবাড়িতে। দেশের বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে। আফসানার আরও তিন ভাইবোন আছে। তারা সবাই সুস্থ-স্বাভাবিক। বড় ভাই ইমরানের বয়স ২৩ বছর। আফসানা সবার ছোট। আট বছর আগে মেয়ের চিকিৎসার কথা ভেবেই পরিবারটি সোনাইমুড়ি থেকে চলে আসে রাজধানীতে। কিন্তু খরচ সংকুলান হয় না।

রোজিনা বেগম বলেন, তিনি দুই বাড়িতে কাজ করে মাসে চার হাজার টাকা আয় করেন। জামাল হোসেন রিকশা চালিয়ে সামান্য যা আয় করেন, তা–ই দিয়ে চলে সংসারের খরচ। টিনশেড ঘরের ভাড়াতেই চলে যায় সাড়ে চার হাজার টাকা। মেয়ের অসুখ সম্পর্কে জানতে চাইলে আফসানার মা বলেন, ‘মেয়ে যখন এক বছর বয়সেও বসতে শেখে নাই, হাঁটতে শেখে নাই, তখন কেমন-কেমন যেন লাগত আমার। তখনো জিহ্বা এত বড় ছিল না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে জিহ্বা বড় হইতেছে। গ্রামে ডাক্তার দেখানো হইছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসক বলছে, মায়ের গর্ভে থাকতেই অসুখ হইছে।’
আফসানার জিহ্বা বড় হতে শুরু করেছে ওর চার বছর বয়স থেকে। ১৪ বছর বয়স হলেও এখনো জন্মদাঁত পড়েনি। এই বয়সে ও প্রথম কিছু ধরে ধরে দাঁড়াতে শিখছে এখন। উচ্চতা দুই ফুটের একটু বেশি। মুখের গড়নও ছোট শিশুর মতো।

আফসানার জিহ্বা বড় হতে শুরু করেছে ওর চার বছর বয়স থেকে। ১৪ বছর বয়স হলেও এখনো জন্মের সময়কার দাঁত পড়েনি। এই বয়সে ও প্রথম কিছু ধরে ধরে দাঁড়াতে শিখছে এখন। উচ্চতা দুই ফুটের একটু বেশি। মুখের গড়নও ছোট শিশুর মতো।

পরিবারটি সংসারের খরচ চালাতে পারে না বলে বড় তিন ছেলেমেয়েকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে গ্রামের বাড়িতে। তবে সমস্যা হয় আফসানাকে দেখাশোনা নিয়ে। মা মানুষের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে গেলে ওকে ঘরে একা থাকতে হয়। মাঝেমধ্যে মা কাজের জায়গায় নিয়ে যান।

আফসানার বাবা জামাল হোসেন ও মা রোজিনা বেগম
ছবি: সংগৃহীত

রোজিনা বেগম জানালেন, এখন ওজন বাড়ছে বলে কোলে করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। ফলে মাঝেমধ্যে ফিরে এসে দেখেন, একা থাকতে থাকতে মেয়ের অবস্থা খারাপ।
গত সোমবার কথা হয় আফসানার মায়ের সঙ্গে। বললেন, কিছুদিন আগে চিকিৎসক দেখানো হয়েছে। আবার এক মাস পর দেখাতে হবে। আপাতত গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে আফসানাকে। নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে দাদি-নানির বাড়িতে আপাতত থাকছে এখন মেয়ে। চিকিৎসক দেখানোর সময় হলে আবার নিয়ে আসা হবে।

রোজিনা আরও বলেন, রাজধানীতে আসার আগে গ্রামে যে যা বলেছে শুনেছেন। বহুবার হেকিম, কবিরাজের কাছে নিয়ে গেছেন। সবশেষ গত অক্টোবরে আফসানাকে দেখানো হয়েছে রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালে। বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। ২৮ অক্টোবর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতাল থেকে দেওয়া ব্যবস্থাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, আফসানার অসুখটি ‘হাইপো থাইরয়েড’।

বারডেম জেনারেল হাসপাতাল এবং ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ আবিদ হোসেন মোল্লার কাছে আফসানার অসুখ সম্পর্কে জানিয়ে এর চিকিৎসা নিয়ে জানতে চাওয়া হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাইপো থাইরয়েড হচ্ছে শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় হরমোনের ঘাটতি। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় শিশুর জন্মের সময়ই থাইরয়েড স্ক্রিনিং হয়। তখনই বোঝা যায় শিশুর এই হরমোনের মাত্রা কত। এ ব্যবস্থা আমাদের দেশে এখনো নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই ঘাটতি হয় জন্মগতভাবে। এ ছাড়া আয়োডিনের অভাবেও অসুখটি হতে পারে। যত কম বয়স থেকে চিকিৎসা শুরু করা যায়, তত বেশি সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমাদের দেশে হাইপো থাইরয়েডের চিকিৎসা খুব ব্যয়বহুল নয়।’

আফসানার মা রোজিনা বেগমের কাছে মেয়ের চিকিৎসা নিয়ে পরবর্তীতে কী করবেন, তা জানতে চাইলে তিনি চুপ হয়ে যান। শুধু এটুকু বললেন, ‘সন্তানের এমন কষ্ট তাকায় তাকায় দেখি। খুব অসহায় লাগে নিজেরে।’