‘আমার সোনার কবরটা দেখায় দেন, মইরা গেলেও শান্তি পাব’

মানববন্ধনে সোহেল রানার ছবি হাতে মা রাশেদা বেগমছবি: প্রথম আলো

‘এত জায়গায় এতখানে গেলাম, আমার ছেলেরে আর খুঁইজা পাইলাম না। কাল সোনার মৃত্যুবার্ষিকী করব। এই মৃত্যুবার্ষিকী করার আগে আমি চাইছি, আমার সোনার কবরটা আমারে একটু দেখায় দেন, তাইলে আমি মইরাও শান্তি পাব।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন সোহেল রানার মা রাশেদা বেগম। তিনি জানান, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে নিহত হন সোহেল।

আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে জুলাই গণহত্যার দ্রুত বিচার, জুলাই ঘোষণাপত্র এবং গণকবর শনাক্তের দাবিতে আয়োজিত মানববন্ধনে বক্তব্য দেন কবর শনাক্ত না হওয়া জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা। মানববন্ধনটি আয়োজন করে জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্স, জুলাই ম্যাসাকার আর্কাইভ, গণকবরে শায়িত শহীদদের পরিবার ও জুলাই ২৪ শহীদ পরিবার সোসাইটি নামের কয়েকটি প্ল্যাটফর্ম।

সোহেল রানার ভাই নাবিল হোসেন বলেন, ‘রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ১১৪টা কবর আছে। কিন্তু কোনটা আমার ভাইয়ের, জানি না। এক দপ্তর থেকে আরেক দপ্তরে ঘুরে বেড়ালেও কোনো তথ্য পাইনি।’ নাবিল প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘কেন এখনো ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে শহীদদের শনাক্ত করা হলো না? কেন এখনো “জুলাই সনদ” ঘোষণা হলো না? কেন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের বিচার হলো না?’

স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ শুনে হাসপাতালে গিয়ে লাশ শনাক্ত করেও পরে আর লাশ খুঁজে পাননি বলে জানান মনির হোসেন রাজুর স্ত্রী মোছা. রেহানা। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী ২০ জুলাই গাজীপুরে গুলি খায়। সেখান থেকে মিছিলের ছাত্ররা গুটিয়া মেডিকেলে (ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল) ভর্তি করে। আমি সেখানে যাইয়া দেখি, আমার স্বামীর লাশ পাকার (মেঝে) মধ্যে শোয়ায় রাখছে। তার সাথে আরও চারটা লাশ ছিল।’

রেহানা বলেন, ‘ডাক্তারে বলেন, মেডিকেল থেকে লাশ নেন। আমি লাশ নেওয়ার জন্য নাম-ঠিকানা সব লিখছিলাম। সাইন করব, এই মুহূর্তে সেনাবাহিনী ও পুলিশের গাড়ি আসে।...এরপর তারা (পুলিশ) লাশগুলো নিয়ে যায়। এরপর আমারে বলে তাজউদ্দীন মেডিকেলে (শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ) যেতে। ওখানে গিয়ে দেখি আমার স্বামীর লাশ নাই। বলে ঢাকা মেডিকেলে যান। ওখানে গিয়েও আর পাইনি।’

মনির হোসেনের স্ত্রী বলেন, ‘এক বছর হয়ে গেল। আমার স্বামীর লাশের আজ পর্যন্ত কোনো সন্ধান পাই নাই। আমার স্বামীর লাশটা না পেলেও কবরটা আমি দেখতে চাই। তবু আমার আত্মা শান্তি পাবে।’

মো. আসাদুলের স্ত্রী ফারজানা আক্তার বলেন, ‘২২ জুলাই আমার স্বামী মারা যান। ২৩ জুলাই লাশ আঞ্জুমান মফিদুলের কাছে দেয়। ২৪ জুলাই রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের ৪ নম্বর ব্লকে বেওয়ারিশভাবে দাফন করা হয়।’ তিনি বলেন, ‘আমার ছোট ছোট দুইটা বাচ্চা আছে। ওরা যখন বড় হবে, তখন তো জিজ্ঞেস করবে ওদের বাবার কবর কোনটা। তখন আমি ওদের কী জবাব দেব?’

ফারজানা আক্তার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এই কবরগুলো শনাক্ত করা এত কঠিন না। মাত্র ১১৪টি কবর। কেন এদের শনাক্ত করে শহীদের মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না? সরকার কি এতটাই দায়িত্বহীন?’

জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত ব্যক্তিদের লাশ শনাক্ত নিয়ে কাজ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাফিসা ইসলাম সাকাফি। তিনি বলেন, ‘মানুষ দিনের পর দিন অপেক্ষা করছে এটা জানার জন্য যে তাদের পরিবারের যে সন্তানটি হারিয়ে গেছে, সে কোন কবরে আছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে অনুরোধ জানাই, এই জুলাই মাসেই যেন নিখোঁজ পরিবারগুলোকে তাদের স্বজনদের খুঁজে পেতে সাহায্য করা হয়। কারণ, তারা এইটুকু পাওয়ার যোগ্য। তাদের এক বছরের অপেক্ষা যেন আর দীর্ঘায়িত না করা হয়।’

এই শিক্ষার্থী বলেন, রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ১১৪টি কবর আছে। লাশগুলো তুলে ডিএনএ মিলিয়ে শনাক্ত করে যথাযথ সম্মানের সঙ্গে দাফন করা এবং সেগুলোকে সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

মানববন্ধনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ইনামুল হাসান বলেন, বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলই জানে না কারা এই গণকবরে শায়িত আছেন। কারও মাথায়ই নেই লাশগুলো শনাক্ত করা কিংবা পরিবারকে ফিরিয়ে দেওয়া জরুরি। তিনি বলেন, গত মাসের ১ তারিখে বলা হয়েছিল ১৫ দিনের মধ্যে প্রক্রিয়া শুরু করতে, কিন্তু স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখাননি।

জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই মন্তব্য করে ইনামুল হাসান আরও বলেন, ‘আমরা শহীদ পরিবার, সংখ্যায় কম হলেও বুক পেতে দিয়েছি। প্রয়োজনে আবার রাস্তায় নামব। আমাদের বাধ্য না করতে গণকবর শনাক্ত ও ঘোষণাপত্র কার্যকর করা হোক।’