মশকনিধন এখন ‘মৌসুমি টেনশন’

ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা
ছবি: রয়টার্স

ডেঙ্গু আগে শুধু রাজধানীতে সীমাবদ্ধ থাকলেও তিন বছর ধরে ঢাকার বাইরেও লোকজন এতে আক্রান্ত হচ্ছে। আর এখন এর প্রাদুর্ভাব সারা দেশেই।

নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, ঢাকায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। তবে ২০০৩ সাল থেকে টানা ১৫ বছর এতে আক্রান্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা কম ছিল। পরে তা বেড়েছে। ২০১৯ সালে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু হয় এ জ্বরে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও মৃত্যুর বছর।

প্রতিবছর দেশের সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো মশকনিধনে যথেষ্ট অর্থ খরচ করলেও মশা নিয়ন্ত্রণে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন মশার কীটনাশক ক্রয়, ফগার মেশিন ক্রয়, যন্ত্রপাতি মেরামতসহ আনুষঙ্গিক খাতে ১২টি সিটি করপোরেশন গত ২০২০-২১ অর্থবছরে খরচ করেছে ১১৩ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি বছরের জুন মাসের শেষ থেকে রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে শুরু করেছে। ফলে মশকনিধন নিয়ে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়েক দিনের থেমে থেমে হওয়া বৃষ্টি এডিস মশার বংশবিস্তারে প্রভাব ফেলছে। তাঁদের আশঙ্কা, আগামী সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

আজ ২০ আগস্ট, বিশ্ব মশা দিবস। প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে দিনটি পালন করা হয়। ব্রিটিশ চিকিৎসক স্যার রোনাল্ড রস ১৮৯৭ সালে আবিষ্কার করেন, স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশার মাধ্যমে ম্যালেরিয়া ছড়ায়। তাঁর এ আবিষ্কারকে স্মরণ করতে যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন দিবসটি পালনের সূচনা করে। ১৯৩০ সালের দিকে শুরু হওয়া এই দিবস পালনের আনুষ্ঠানিকতা দিন দিন বাড়ছে।

বাংলাদেশে সারা বছরই কমবেশি আলোচনায় থাকে মশা। বিশেষ করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মশার উপদ্রবে টেকা দায়। যদিও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন চলতি অর্থবছরেও মশকনিধন খাতে বরাদ্দ রেখেছে ৫০ কোটি টাকার বেশি। তাদের এসব খরচের বড় অংশই হচ্ছে কীটনাশক ক্রয়ে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশকনিধন এখন ‘মৌসুমি টেনশন’ হয়ে গেছে। যখন রোগী বাড়ে, তখন হইচই হয়, রোগী কমলেই আলোচনা থেমে যায়। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো বিক্ষিপ্তভাবে মশা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম চালাচ্ছে। পুরো কার্যক্রমে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা (ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট) গড়ে তোলা বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে সুপারিশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনায় কয়েকটি বিষয় জড়িত থাকে বলে বিশেষজ্ঞরা জানান। এর মধ্যে মশার প্রজননস্থল কমানো, উপকারী প্রাণীর মাধ্যমে মশা নিয়ন্ত্রণ, মশা নিয়ন্ত্রণে লার্ভিসাইড (লার্ভা মারার ওষুধ) ও অ্যাডাল্টিসাইড (উড়ন্ত মশা মারার ওষুধ) ব্যবহার এবং মশা নিয়ন্ত্রণে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে উদ্যোগ গ্রহণ অন্যতম। সমন্বিত ব্যবস্থাপনা না থাকায় সারা দেশে কাজগুলো বিচ্ছিন্নভাবে হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর বছরভিত্তিক তথ্য রাখছে। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় সাড়ে ৫ হাজার ব্যক্তি। এর পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৬ হাজারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১৮ সালে এসে প্রথমবারের মতো রোগীর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়ায়।

২০১৯ সালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা আগের সব বছরের রেকর্ড ছাড়ায়। ওই বছর সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। সরকারি হিসাবে ওই বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা ছিল ১৭৯। মাঝে ২০২০ সালে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কম ছিল। আর গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় ২৮ হাজার ৪২৯ জন; মৃত্যু হয় ১০৫ জনের।

২০১৯ সালের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশকনিধনে বছরব্যাপী কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে। তাতে ডেঙ্গুর প্রাক্‌-মৌসুম (জানুয়ারি-মার্চ), মৌসুম (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) ও মৌসুম-পরবর্তী (অক্টোবর-ডিসেম্বর) কার্যক্রমের পরিকল্পনা রয়েছে। কর্মপরিকল্পনার বড় অংশজুড়ে ছিল জনসচেতনতা তৈরি। জনগণকে সম্পৃক্ত করতে চিরুনি অভিযান ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা এবং মাইকিং করা হচ্ছে। তবে পরিস্থিতির খুব একটা বদল হচ্ছে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে আজ ২০ আগস্ট (শনিবার) পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে ৪ হাজার ৩৪৪ জন। এর মধ্যে ৪৩০ জন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। মারা গেছেন ১৮ জন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়েক দিনের থেমে থেমে হওয়া বৃষ্টি এডিস মশার বংশবিস্তারে প্রভাব ফেলছে। তাঁদের আশঙ্কা, আগামী সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

সরকার ডেঙ্গু রোগীর যে তথ্য দিচ্ছে, তা রাজধানীর ৪৫টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল এবং জেলা হাসপাতালগুলোতে ভর্তি রোগীর। অন্যান্য হাসপাতাল ও বাড়িতে থেকে কত রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন, সেটি জানা যায় না। অনেক এলাকায় ঘরে ঘরে ডেঙ্গু রোগী থাকলেও তাঁদের তথ্য আসছে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মশার সমস্যা সারা দেশেই। কেন্দ্রীয়ভাবেই সেটির ব্যবস্থাপনা হওয়া উচিত। মশা মারতে কীটনাশক নির্ধারণ, মশা নিয়ন্ত্রণে গবেষণার কাজ করবে কেন্দ্রীয় মশা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। কেন্দ্র করে যাকে-তাকে দায়িত্বে বসিয়ে দিলে হবে না।’ তিনি বলেন, ‘মশক নিয়ন্ত্রণে বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের প্রাধান্য দিতে হবে। সঠিকভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে সারা দেশের জন্য একটি সমন্বিত কীটব্যবস্থাপনা থাকা প্রয়োজন।’