দিনে মাত্র ৯৮৯ টাকা পেতে বাহাদুর শাহ পার্ক ‘ধ্বংস’ 

গত অক্টোবর থেকে ঐতিহাসিক এই পার্কে খাবারের দোকান বসিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। নষ্ট হয়েছে পার্কের স্বাভাবিক পরিবেশ। 

ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে অবকাঠামো নির্মাণের পর রাতে দোকান চালু রাখতে নানাভাবে আলোকসজ্জা করেছেন ইজারাদার। গতকাল সন্ধ্যায় পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে
প্রথম আলো

পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা এবং পরিবেশবাদীদের তীব্র আপত্তি ও প্রতিবাদের পরও বাহাদুর শাহ পার্কের ভেতর থেকে খাবারের দোকান সরেনি। দৈনিক মাত্র ৯৮৯ টাকা ভাড়ায় গত অক্টোবর থেকে ঐতিহাসিক এই পার্কে খাবারের দোকান বসিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ওই দোকানকে কেন্দ্র করে পার্কের ভেতরে রাতে আলোকসজ্জার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এতে পার্কের স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি পাখির আনাগোনা কমে গেছে। 

দোকান বসানোর কারণে এই পার্কের সবুজ চত্বরে নিজের মতো হাঁটা বা বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে। দোকান বসানোর কারণে পার্কের তিন ভাগের প্রায় এক ভাগ জায়গা কার্যত ইজারাদারের দখলে চলে গেছে। পার্কের ভেতরে ‘ফুড ভ্যান’ বা খাবারের দোকান বসানোর ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের শর্ত ছিল, এটি এমনভাবে স্থাপন করতে হবে, যাতে যেকোনো সময় তা স্থানান্তর করা যায়। তবে ইজারাদার শর্ত না মেনে পার্কের ভেতরে স্থায়ী অবকাঠামো তৈরি করেছেন। এ নিয়ে নানা মহল থেকে আপত্তি তোলা হলেও সিটি করপোরেশন ইজারাদারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

খাবারের অসংখ্য দোকান আশপাশে আছেই। পার্কের ভেতরে খাবারের দোকান দিতে হবে কেন? আলোকসজ্জার কারণে রাতের বেলায় পার্কটিকে অনেকটা নাইট ক্লাবের মতো মনে হয়।
ব্যবসায়ী রাজীব উল্লাহ

বাহাদুর শাহ পার্কের আয়তন ৮৫ দশমিক ৩ কাঠা। এই পার্কের চারপাশে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কবি নজরুল সরকারি কলেজসহ অন্তত ১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও এই পার্ক ব্যবহার করেন।

বাহাদুর শাহ পার্কে খাবারের দোকান চালু করায় এক বছরে ইজারাদারের কাছ থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আয় হবে ৩ লাখ ৬১ হাজার টাকা। ইজারা নিয়েছে ডিএআর হোল্ডিং লিমিটেড নামের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। 

বাহাদুর শাহ পার্কের ভেতরে খাবারের দোকান বসিয়ে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট করার প্রতিবাদে গত আট মাসে ১৮ দিন নানা ধরনের প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। এই পার্ক রক্ষার দাবিতে স্থানীয় বাসিন্দাদের চারটি সংগঠন মিলে গড়ে তুলেছে ‘ঐতিহাসিক বাহাদুর শাহ পার্ক ও পার্কের ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংগ্রাম পরিষদ’। 

এই সংগঠনের সদস্যসচিব আক্তারুজ্জামান খান গতকাল শুক্রবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় মানুষের আপত্তি, প্রতিবাদ, অনুরোধ কোনো কিছু আমলে নিচ্ছে না সিটি করপোরেশন। তবে আন্দোলন থামবে না। বাহাদুর শাহ পার্কের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় শেষ চেষ্টা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেওয়ার কথা ভাবছেন তাঁরা।

গতকাল বিকেল পাঁচটার দিকে পার্কে গিয়ে দেখা যায়, খাবারের দোকানের চারপাশের মোট ২১টি গাছে আলোকসজ্জা করা হয়েছে। দোকানের চারদিকের খোলা জায়গা ঢালাই করে সেখানে ৮টি টেবিল ও ২৩টি চেয়ার বসানো হয়েছে। 

পার্কের পাশের টিপু সুলতান রোডের ব্যবসায়ী রাজীব উল্লাহ বলেন, খাবারের অসংখ্য দোকান আশপাশে আছেই। পার্কের ভেতরে খাবারের দোকান দিতে হবে কেন? আলোকসজ্জার কারণে রাতের বেলায় পার্কটিকে অনেকটা নাইট ক্লাবের মতো মনে হয়।

ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে পার্কের ভেতরে স্থাপনা নির্মাণ ও আলোকসজ্জার বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরীন প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি তিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। ইজারার শর্ত ভঙ্গ করা হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

বাংলাপিডিয়া ও ঢাকা জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, এই পার্ক আগে ভিক্টোরিয়া পার্ক নামে পরিচিত ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় ভিক্টোরিয়া পার্ক বিশেষ পরিচিতি অর্জন করে। এখানে কয়েকজন বিদ্রোহীকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ১৮৫৮ সালে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার বিপুলসংখ্যক মানুষের এক সমাবেশে রানি ভিক্টোরিয়ার বিখ্যাত ঘোষণা পাঠ করেন। সিপাহি বিদ্রোহ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইংরেজ শাসনের সমাপ্তি ঘটিয়ে মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহর শাসন পুনরায় আনার জন্য। তাই তাঁর নামানুসারে এর নতুন নামকরণ করা হয় ‘বাহাদুর শাহ পার্ক’।

পার্কের ভেতরে দোকান বসানো নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ গতকাল সন্ধ্যায় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, পার্কটি দেখভালের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। তারা যেটা ভালো মনে করে, সেটাই করেছে। 

 বাহাদুর শাহ পার্ক রক্ষার দাবিতে গত ২১ জানুয়ারি এই পার্কের ভেতরে স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্যোগে সুধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সমাবেশে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ অভিযোগ করেন, ‘মুনাফাখোরদের’ আগ্রাসনের শিকার হতে যাচ্ছে পার্কটি। সেদিন তিনি আরও বলেছিলেন, ‘পুরো দেশের জন্য এই পার্ক গুরুত্বপূর্ণ। এমন উন্নয়ন চাই না, যে উন্নয়নে কিছু মুনাফাখোরের হাতে টাকা জমতে থাকবে, সম্পদ জমতে থাকবে। আর দেশের বেশির ভাগ মানুষ অতিষ্ঠ হবে, অসুস্থ হবে। তাদের উন্মুক্ত জায়গা দখল হয়ে যাবে।’