জলাধার আইন লঙ্ঘন করে হাতিরঝিল ভরাট হচ্ছে, আইপিডির পর্যবেক্ষণ

রাজধানীর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে ওয়েবিনারের আয়োজন করে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উন্নয়নকাজের জন্য হাতিরঝিল ভরাট জলাধার সংরক্ষণ আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ভরাটের ফলে হাতিরঝিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পানিপ্রবাহ ও সার্বিক উপযোগিতা ধ্বংস হবে। খেলার মাঠ, জলাধার ও পার্ক ধ্বংস করে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প করা হলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারছে না।

‘হাতিরঝিল, পান্থকুঞ্জ পার্ক এবং সংলগ্ন এলাকার ওপর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পরিকল্পনাগত প্রভাব: আইপিডির পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এসব কথা বলা হয়। আজ শনিবার নগর গবেষণা ও নীতিবিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) এ ওয়েবিনারের আয়োজন করে।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উন্নয়নকাজের অংশ হিসেবে রাজধানীর হাতিরঝিলের একাংশ ভরাট করা হচ্ছে। এর ৪১টি খুঁটি বা পিলার বসবে হাতিরঝিলের ইস্কাটন অংশের পাড় ঘেঁষে। এক্সপ্রেসওয়ের অংশ হিসেবে হাতিরঝিল হয়ে কাঁটাবন দিয়ে পলাশী মোড় পর্যন্ত একটি উড়ালপথে সংযোগ সড়ক থাকবে। হাতিরঝিল ভরাট করা হচ্ছে মূলত এই উড়ালসড়ক নির্মাণের অংশ হিসেবে। বিষয়টি নিয়ে গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোতে ‘হাতিরঝিলের পাড় ঘেঁষে বসবে খুঁটি’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

ওয়েবিনারে আইপিডির পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান। তাতে বলা হয়, এক্সপ্রেসওয়ের একটি এক্সটেনশন লিংক (বর্ধিত অংশ) হাতিরঝিলের ওপর দিয়ে যাবে। এই অ্যালাইনমেন্ট এখনো অনুমোদন করেনি রাজউক। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল পরিকল্পনায় এটি ছিল না। এই এক্সপ্রেসওয়ে করার উদ্দেশ্য ছিল ঢাকা শহরকে বাইপাস করে যানজট এড়িয়ে যাতায়াত। কিন্তু ওঠা-নামার পথ তৈরি করে ঢাকার ভেতরে ঢুকে গেছে এই এক্সপ্রেসওয়ে।

আইপিডির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, রাজউক, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা ও সমন্বয় না করেই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এই এক্সটেনশন লিংকের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে উচ্চগতির ট্রান্সপোর্ট সেবা, অথচ এই এক্সটেনশনের মাধ্যমে এক্সপ্রেসওয়েকে লোকাল ট্রান্সপোর্ট সেবা হিসেবে ব্যবহার করতে চাচ্ছে। এতে আশপাশের এলাকার যানবাহন চলাচল বাধাগ্রস্ত হবে এবং যানজট বেড়ে যাবে।

আইপিডির উপদেষ্টা এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, শহরের উন্নয়ন কার্যক্রমে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে দ্বিচারিতা দেখা যাচ্ছে। সবুজায়নের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু গাছ কাটা হচ্ছে। ফুটপাত প্রশস্ত করার কথা বলা হলেও ফুটপাত সংকুচিত করা হচ্ছে। জলাধার সংরক্ষণের কথা বলা হলেও সেগুলো ভরাট করা হচ্ছে।

আকতার মাহমুদ বলেন, এক্সপ্রেসওয়ের একটি নিজস্ব চরিত্র আছে। কিন্তু ঢাকার এই এক্সপ্রেসওয়ে জনঘনত্ব এলাকার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। একের পর এক ওঠা-নামার র‍্যাম্প নামছে শহরের ভেতরে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এই বর্ধিতাংশের প্রয়োজনীয়তা কী, কারা সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। ঢাকার পরিবহনসংশ্লিষ্ট সব কাজ সমন্বয় করার কথা ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ), কিন্তু তারা তাদের কাজ করতে পারছে না।

ওয়েবিনারে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, নগরে পরিবেশবিধ্বংসী কার্যক্রম চলছে। খেলার মাঠ, জলাধার, গাছ, পার্কের ওপর আঘাত আসছে। এই নগর দেখভালের দায়িত্বে কে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। উচ্চ আদালত হাতিরঝিলকে ঢাকার ফুসফুস বলছেন। সেই ফুসফুসে ৪১টি পিলার বা পেরেক ঢোকানো হলে কী অবস্থা দাঁড়াবে। হাতিরঝিল ভরাটের মতো গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।

ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতাকে গলা চেপে হত্যা করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন আইপিডির পরিচালক ও নগরবিদ আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, নগরের মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন। তাঁদের সুবিধার জন্য বিপুল ব্যয়ে এক্সপ্রেসওয়ের মতো অবকাঠামো বানানো হচ্ছে। মূল শহরকে বাইপাস করে এক্সপ্রেসওয়ে করা হলে নির্মাণ খরচ উঠে আসবে না, তাই শহরের মাঝখান দিয়ে র‍্যাম্প বানানো হচ্ছে।

ওয়েবিনার থেকে অবিলম্বে হাতিরঝিলে ভরাট কার্যক্রম বন্ধের দাবি জানায় আইপিডি। তারা বলছে, এই ভরাটের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ও পরিকল্পনার ব্যতয় ঘটে থাকলে তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। হাতিরঝিল থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উন্নয়নকাজের ৪১টি পিলার সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

আইপিডির এসব পর্যবেক্ষণের বিষয়ে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের সমন্বয়কারী ও সহকারী প্রকল্প ব্যবস্থাপক মিসবাহিল মোকার রাবিন প্রথম আলোকে বলেন, হাতিরঝিল দিয়ে পান্থকুঞ্জ পার্ক হয়ে পলাশী পর্যন্ত এই র‍্যাম্পটি এক্সপ্রেসওয়ের মূল পরিকল্পনাতেই ছিল। এর অংশ হিসেবে পান্থকুঞ্জ এলাকা সেতু কর্তৃপক্ষ অধিগ্রহণও করেছে। এক্সপ্রেসওয়ের হাতিরঝিল অংশের নকশা বিনিয়োগকারীরা করেনি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে এটি করা হয়েছে। তিনি বলেন, এই ভরাট অস্থায়ী। সরকারের অনুমোদিত প্রকল্প কাজের সুবিধার্থে সাময়িক ভরাট করা হচ্ছে। কাজ শেষ হলে খনন করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের শুরু ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে। বনানী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, সায়েদাবাদ হয়ে এটি যাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত। দৈর্ঘ্য ২০ কিলোমিটারের মতো। পুরো পথে মোট ১৫টি ওঠার ও ১৬টি নামার জায়গা থাকবে।

আরও পড়ুন