‘বিকট শব্দ, বিস্ফোরণ, তারপর ঠাস, ঠাস, ঠাস শব্দ...’

শারমীন ইমা
ছবি: সংগৃহীত

‘বিকট শব্দ, বিস্ফোরণ, তারপর ঠাস, ঠাস, ঠাস শব্দ...সাজানো একটি সংসার ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো। ৭৫ বছর বয়সী শ্বশুরকে জরুরি অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। দেবরের মাত্র ৯ মাস বয়সী ছেলে মাহরিব আকরাম রাদিব ঘটনার পর থেকেই ভয় পাচ্ছে। বাসার ড্রয়িং রুমের কোনো জিনিস আস্ত নেই। গতকাল রোববার ভয়ে আমরা কেউ ঘুমাতে পারিনি। সব মিলে ধকলটা কেমনে সামলাবে তা চিন্তাই করতে পারছি না।’

কথাগুলো বললেন শারমীন ইমা। তিনি সাবেক সরকারি কর্মকর্তা মাহবুবুন নবীর বড় ছেলের বউ। গতকাল রোববার সকালে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার শিরিন ভবনে বিস্ফোরণ হয়। শারমীন ইমা এ ভবনের লাগোয়া পাশের ভবনের বাসিন্দা। ভবনটি ১৫ তলা। শারমীন ইমারা থাকেন তৃতীয় তলায় (ডুপ্লেক্স)। গতকাল বেলা পৌনে ১১টার দিকে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে শিরিন ভবনের তিনতলায়। বিস্ফোরণের পরপর আগুন ধরে যায় এ ভবনে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ১০টা ৫৫ মিনিটে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। তবে শারমীন ইমাদের বাসায় আগুন লাগেনি।

আরও পড়ুন

শারমীন ইমা জানালেন, ঘটনার পর সবাই শিরিন ভবন নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন, অনেকে ধারণাও করতে পারেননি পাশের ভবনটিরও এমন ভয়াবহ অবস্থা হতে পারে। শারমীন ইমাদের ভবনের ষষ্ঠ তালা পর্যন্ত জানালার কাচ ভেঙেছে, তবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তৃতীয় তলার তাঁদের ফ্ল্যাটটি।

শারমীন ইমা জানান, তিনি সকালে দেবরের ৯ মাস বয়সী ছেলেকে পায়ে দোল দিতে দিতে ঘুম পাড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ বিকট শব্দ। পুরো ভবন কাঁপছিল। বললেন,‌ ‘তখন আমি আমার নিজের কথা চিন্তা করিনি। শুধু মনে হচ্ছিল দেবরের বাচ্চাটাকে যে করেই হোক বাঁচাতে হবে। ও তো আমার কোলেই ছিল। কোনোভাবে ওকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকি। তখন সারাক্ষণ ভয় পাচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল পুরো ভবন ধসে পড়বে। বের হতে হতে শুনি শ্বশুর ড্রয়িং রুমে আটকা পড়েছেন। ছেলেকে দেবরের বউয়ের কোলে দিয়ে দৌড়ে শ্বশুরের ঘরে যাই।’

আরও পড়ুন

শারমীন ইমা আরও বলেন, ‘আমার শ্বশুর সকালে টেলিভিশন দেখতে দেখতে ড্রয়িং রুমে বসে পত্রিকা পড়েন। গতকাল টেলিভিশন বন্ধ ছিল। বাবা পত্রিকা পড়ছিলেন। আমি আমার বেডরুমে ছিলাম। শাশুড়ি ও দেবরের বউ অন্য জায়গায় ছিলেন। ড্রয়িং রুমের দেয়াল উড়ে গেছে। পুরো ঘরটাই লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। বাবার মাথায় কোনো কিছুর আঘাতে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কেটে গেছে।’

আহত সাবেক সরকারি কর্মকর্তা মাহবুবুন নবী
ছবি: প্রথম আলো

শারমীন ইমা বলেন, ‘বাবার সারা শরীরে রক্ত। ঘরের মেঝেতে রক্ত। আমি পাগলের মতো বলছি কেউ বাবাকে বাঁচান। কিন্তু কে বাঁচাবে। নিচে তখন মানুষের জটলা। অনেকে মুঠোফোনে তা ভিডিও করছেন। তখন মনে হয়েছে আজব দুনিয়ায় আছি। অবশ্য ভবনের যে অবস্থা অনেকে ভয়েও কাছে আসার সাহস পাচ্ছিলেন না। পরে আমাদের ভবনেরই অন্য কোনো ফ্ল্যাটের একজন এবং আমাদের ভবনের দুজন এসে কোনোভাবে বাবাকে বের করেন। তিনজনের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।’

শারমীন ইমা জানালেন, ঘটনার সময় তাঁর স্বামী এবং দেবর অফিসে ছিলেন। দেবরের বন্ধুরা শ্বশুরকে হাসপাতালে নিয়ে যান। শ্বশুরের হাতের মাংস থেতলে গেছে। তাঁর ডায়াবেটিস, তাই অস্ত্রোপচার করা যাচ্ছে না। অন্যান্য পরীক্ষা–নীরিক্ষা চলছে হাসপাতালে।

বিস্ফোরণে ধ্বংসস্তুপ
ছবি: প্রথম আলো

পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শারমীন ইমা বলেন, ‘গতকাল মনে হচ্ছিল বাসার আমরা সবাই মারা যাচ্ছি। শ্বাসকষ্ট শুরু হয় সবার। পাশের ভবনে আগুন লাগার পর মনে হয়েছিল আমাদেরও আগুনে পুড়ে মরতে হবে। ফায়ার সার্ভিস ঠিক সময়ে না এলে আমাদের ভবনেও আগুন ছড়িয়ে যেত। আমার পরিবারের সবাই বেঁচে আছেন এটাই সব থেকে বড় কথা। শুকরিয়া আদায় করছি। ড্রয়িং রুমের কোনো জিনিস বলতে গেলে আর আস্ত নেই। বাসার অন্য রুমের জিনিসপত্র পরে আর ব্যবহার করা যাবে বলে মনে হয় না। তাই আর্থিক ক্ষতি কত হতে পারে তা আমরা এখনো ধারণা করতে পারছি না।’

শারমীন ইমা বলেন, গতকাল তাঁর স্বামী ও দেবর বাধ্য হয়ে রাতে ওই বাসাতেই ছিলেন। কেননা বাসা তো এখন পুরো অরক্ষিত। আর পরিবারের অন্যরা এক  আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলেন। কিন্তু এভাবে কত দিন স্বজনের বাসায় থাকা সম্ভব? ভবনের যে অবস্থা হয়েছে, তা মেরামত করতে সময় লাগবে। হাসপাতালের খরচসহ অন্যান্য খরচ তো আছেই।

গতকাল রোববার বেলা পৌনে ১১টার দিকে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে শিরিন ভবনের তিনতলায়। এতে তিনজন নিহত হন। আহত হন ১৫ জন। আহত ব্যক্তিরা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ভবনে বিস্ফোরণ নিয়ে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট জানিয়েছে, জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ হয়েছে।

শারমীন ইমা শিরিন ভবনের কথা উল্লেখ করে বলেন, ভবনটি পুরোনো। নাজুক অবস্থায় ছিল। বললেন, এর আগে তাঁরা নিজেরাও আলাপ করতেন যে ভূমিকম্প হলে ভবনটি ধসে পড়বে আর তার প্রভাব পড়বে নিজেদের ভবনে। ভূমিকম্প পর্যন্ত আর অপেক্ষা করতে হলো না।

ভবনের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ
ছবি: প্রথম আলো

শারমীন ইমা বলেন, শুধু সরকারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ভবনের মালিক বা বাসিন্দারাও তো সচেতন নয়। ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হলে তা মেরামত করা বা ভেঙে ফেলা হচ্ছে না। গ্যাসের লাইনসহ কোনো কিছুর দিকেই নজর দেওয়া হচ্ছে না। বাণিজ্যিক ভবন, আবাসিক ভবন সব এক জায়গায় হচ্ছে। বিষয়টি গুরুত্বই পাচ্ছে না। যখন কোনো একটি ঘটনা ঘটছে, তারপর সবাই তৎপর হচ্ছে। কিন্তু তখন যা হওয়ার তো হয়েই যায়।

ঘটনার পর বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত শিরিন ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবন জনসাধারণের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ’ লেখা সাইনবোর্ড ঝুলছে।