ঢাবির ফজলুল হক হলে ছাত্রলীগের দুই পক্ষে সংঘর্ষ, যোগ দিয়েছিলেন শহীদুল্লাহ হলের নেতা-কর্মীরাও  

ফজলুল হক মুসলিম হলের কক্ষের জানালা ভাঙচুর করে ছাত্রলীগের একটি পক্ষ
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ঐতিহ্যবাহী ফজলুল হক মুসলিম হলে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসানের এক অনুসারীকে কক্ষছাড়া করার অভিযোগের জেরে হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেনের অনুসারীদের সঙ্গে সোমবার দিবাগত রাতে এ সংঘর্ষ হয়। এতে হলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষের একপর্যায়ে তানভীরের অনুসারীরা হলছাড়া হয়ে পড়েন। খবর পেয়ে পার্শ্ববর্তী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হল থেকে তানভীরের অনুসারীরা ফজলুল হক হলে গিয়ে একজোট হয়ে বিভিন্ন কক্ষে হামলা চালান। পরে ফজলুল হক হল শাখার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীরা শহীদুল্লাহ্ হলের কর্মীদের পিটিয়ে বের করে দেন।

ফজলুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেনের কক্ষে গতকাল রাতে প্রীতিভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। আমন্ত্রিত হয়ে সেখানে যান বিভিন্ন হলের এক ডজন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক। আয়োজন চলাকালে রাত সাড়ে ১২টার দিকে হলের বর্ধিত ভবনের ৫০০৬ নম্বর কক্ষ থেকে তানভীর হাসানের এক অনুসারীকে বের করে দেন আনোয়ারের অনুসারীরা। ঘটনার প্রায় আধা ঘণ্টা পর আনোয়ারের কক্ষের সামনে গিয়ে তানভীর হাসানের একদল অনুসারী গালিগালাজসহ ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করতে থাকেন। তাঁরা কক্ষের দরজার কাচ ও জানালা ভাঙচুর করেন। এর জের ধরে আনোয়ারের অনুসারীরা সংঘবদ্ধ হয়ে তানভীরের অনুসারীদের পিটিয়ে হলছাড়া করেন। এরপর রাত তিনটার দিকে শহীদুল্লাহ্ হল থেকে তানভীর হাসানের অনুসারীরা ফজলুল হক হলে গিয়ে ওই হলের বিভিন্ন কক্ষে হামলা চালান। পরে ফজলুল হক হলের সভাপতি আনোয়ার ও সাধারণ সম্পাদক আবু হাসিবের অনুসারীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে শহীদুল্লাহ্ হলের নেতা-কর্মীদের পিটিয়ে বের করে দেন।

হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেনের অভিযোগ, তানভীর হাসানের নির্দেশে তাঁর অনুসারীরা হামলা করেছেন। আনোয়ারের ভাষ্য, ‘হলের আসন নিয়ে গতকাল রাত সাড়ে ১২টার দিকে দুই পক্ষের ঝামেলা হয়। আমার কক্ষে প্রীতিভোজের আয়োজন ছিল। খাওয়াদাওয়া শেষে সবাই কক্ষে অবস্থান করছিলাম। রাত দেড়টার দিকে তানভীরের অনুসারী (হল শাখা ছাত্রলীগের গ্রন্থনা ও প্রকাশনাবিষয়ক উপসম্পাদক) শাওন চৌধুরী ও (উপদপ্তর সম্পাদক) জিহাদুল ইসলামসহ ৮-১০ জন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ আমার কক্ষে হামলা করেন। পালিয়ে যাওয়ার সময় হাতেনাতে ধরার পর তাঁরা স্বীকার করেন যে তানভীরের নির্দেশে তাঁরা হামলা করেছেন। পরে দ্বিতীয় দফায় শহীদুল্লাহ্ হল শাখার পদধারী তানভীরের অনুসারীরা রাতভর ফজলুল হক হলের দক্ষিণ ভবনের বিভিন্ন কক্ষে হামলা চালান। হামলায় ফজলুল হক হলের অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থী আহত হন।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী ফজলুল হক মুসলিম হল
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

এদিকে গতকাল রাতের ঘটনায় তানভীর হাসানের অনুসারীদের ভাষ্য হচ্ছে, রাত সাড়ে আটটা থেকে নয়টার দিকে ফজলুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক আবু হাসিব তাঁদের অনুসারীদের ডেকে সভা করেন। পরে হলের বর্ধিত ভবনের ৫০০৬ নম্বর কক্ষে পারভেজ নামে তানভীর হাসানের অনুসারীকে পিটিয়ে কক্ষ থেকে বের করে দিয়ে ওই কক্ষে তালা দেন আনোয়ারের অনুসারীরা। ফজলুল হক হলে তানভীরের অনুসারীদের বড় অংশ এ ঘটনার সময় হলের বাইরে ছিলেন। খবর পেয়ে তানভীরের অনুসারীরা হলে গিয়ে ৫০০৬ নম্বর কক্ষের তালা ভেঙে সেখানে পারভেজকে তুলে দেন। এরপর আনোয়ারের নির্দেশে তাঁর অনুসারীরা সংঘবদ্ধ হয়ে তানভীরের অনুসারীদের ওপর হামলা করেন। এতে তানভীরের অনুসারী ৯ জন আহত হন। এর মধ্যে তিনজনের মাথা ফেটে গেছে।

সংঘর্ষে আহত ব্যক্তিরা ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিয়েছেন। প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে রাতেই হলে ফিরেছেন তাঁরা।

জানতে চাইলে তানভীর হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফজলুল হক হলে ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে বা ঠিক কী ঘটেছে, তা তদন্তসাপেক্ষ। এ ঘটনায় প্রয়োজনে আমরা সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নেব। সবাই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী, আর ছাত্রলীগ কোনো গ্রুপিংয়ে বিশ্বাস করে না।’

এ বিষয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সুষ্ঠু একাডেমিক পরিবেশ বজায় রাখার জন্য আমাদের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। আমরা স্মার্ট ছাত্ররাজনীতি নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছি। সবাই একসঙ্গে কাজ করবে এবং সংগঠনের কর্মীদের মধ্যে একটি আদর্শিক ঐকতান থাকবে—সেটিই আমাদের লক্ষ্য। ছাত্রলীগে গ্রুপিং বা উপদলীয় রাজনীতি বন্ধ করারও সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। কেউ এর ব্যত্যয় ঘটালে তাঁর বিরুদ্ধে আমরা সর্বোচ্চ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেব।

ফজলুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেনের কক্ষের দরজার কাচ ভাঙচুর করা হয়
ছবি: সংগৃহীত

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের হল কমিটি হয়েছে। ১৮টি হলের ৩৬টি সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদ তখন ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়েছিল। কিন্তু গত ২০ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নতুন কমিটি ঘোষণার পর পাল্টে গেছে প্রেক্ষাপট। নতুন চার শীর্ষ নেতাকে (কেন্দ্রীয় দুই নেতা সাদ্দাম হোসেন ও শেখ ওয়ালী আসিফ এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা মাজহারুল কবির ও তানভীর হাসান) ঘিরে অঞ্চলভিত্তিক নতুন পক্ষ তৈরি হয়েছে। ফলে গত বছর গঠিত হল শাখার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের কর্তৃত্ব এখন শেষ হওয়ার পথে। ফজলুল হক হলের গতকালের মারামারির পেছনেও এই কারণটি কাজ করেছে বলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা জানিয়েছেন।

হামলার প্রতিবাদে সোমবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে মধুর ক্যানটিনের সামনে অবস্থান নেন বিভিন্ন হল শাখা ছাত্রলীগের ২২ জন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক। সেখানে থাকা একাধিক হল শাখার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক প্রথম আলোকে বলেন, অপমানের বিষয়টি তাঁরা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে জানিয়েছেন। এর বিচার চেয়ে তাঁরা শিগগিরই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে যাবেন।

সংঘর্ষের বিষয়ে জানতে ফজলুল হক হলের প্রাধ্যক্ষ শাহ্ মো. মাসুমের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ফজলুল হক হলের একাধিক ছাত্র জানিয়েছেন, হলের পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। তবে গতকালের সংঘর্ষের পর থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসন কঠোর না হলে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ হলে থাকবে না।

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, ‘গতকাল রাতেই বিষয়টি নিয়ে কথা হয়েছে। হল প্রশাসন বিষয়টা দেখছে। এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে, সে জন্য আমরা শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা ও দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করি৷’