রাস্তা দখলদারদের তালিকা করতে চান না কাউন্সিলররা

মেয়রের নির্দেশের ছয় মাস পরও কোনো কাউন্সিলর রাস্তা দখলকারীদের তালিকা করেননি।

  • একজন কাউন্সিলর বলেন, তালিকা তৈরি করতে গেলে রাজনৈতিকভাবে নানা ঝামেলা হয়।

  • আরেকজন কাউন্সিলর বলেছেন, মেয়রের নির্দেশের পর কোনো চিঠি আসেনি, তাই তালিকা করা হয়নি।

  • ঢাকা উত্তর সিটিতে আগে ওয়ার্ড ছিল ৩৬টি। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে আরও ১৮টি ওয়ার্ড যুক্ত হয়।

বিভিন্ন ওয়ার্ডে রাস্তার জায়গা কারা দখলে রেখেছে, সে তালিকা মেয়রকে দিতে চান না কাউন্সিলররা। ছয় মাস আগে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রতিটি ওয়ার্ডে রাস্তা দখলকারীদের তালিকা জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন কাউন্সিলরদের। কিন্তু একজনও তালিকা জমা দেননি। ঢাকা উত্তর সিটিতে ওয়ার্ড রয়েছে ৫৪টি।

দখল হওয়া রাস্তার তালিকা না দেওয়ার বিষয়ে ১০ জন কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলছেন, গত ২৭ জানুয়ারি সিটি করপোরেশনের ভার্চ্যুয়াল বোর্ড সভায় রাস্তা দখলকারীদের তালিকা দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন মেয়র। কিন্তু এ নিয়ে পরে আলাদাভাবে আর কোনো চিঠি বা নোটিশ দেওয়া হয়নি। তাই তাঁরা দখলদারদের তালিকা করেননি। তা ছাড়া মেয়রের নির্দেশ দেওয়ার পর বহু দিন চলে গেছে, অনেকে ভুলেও গেছেন। মেয়রও বিষয়টি নিয়ে আর কিছু বলেননি।

ঢাকা উত্তর সিটির আগারগাঁও এলাকার ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফোরকান হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ভার্চ্যুয়াল সভায় এতজন একসঙ্গে কথা বলে যে ভালো করে সব সময় কথা বোঝাও যায় না। যে কারণে মেয়রের নির্দেশনা তিনি শুনতে পাননি।

তালিকা জমা দিতে কাউন্সিলরদের চিঠি দিয়ে এবার সময় বেঁধে দেওয়া হবে। কেউ নির্দেশনা না মানলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রাস্তা দখলমুক্ত করতে যা যা করা দরকার, এর সবই করা হবে।
আতিকুল ইসলাম, মেয়র, িডএনসিসি

অন্যদিকে মেয়রের নির্দেশনার বিষয়টি বোর্ড সভায় শুনলেও তালিকা তৈরির জন্য চিঠি পাওয়ার অপেক্ষায় থাকার কথা জানান উত্তরখান এলাকার ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জয়নাল আবেদীন।

আতিকুল ইসলাম
ফাইল ছবি

মেয়রের নির্দেশনার বিষয়টি কাউন্সিলরদের লিখিতভাবে না জানানোর বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা প্রথম আলোকে বলেন, বোর্ড সভার কার্যবিবরণীর অনুলিপি সব কাউন্সিলরকে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ওই নির্দেশ এবং সিদ্ধান্ত প্রকাশ্যেই হয়েছে। এখানে আলাদা করে চিঠি দেওয়ার কোনো বিষয় নেই।

গত ২৭ জানুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের দশম বোর্ড সভায় (ভার্চ্যুয়াল) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছিলেন, বিভিন্ন ওয়ার্ডে রাজউকের নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে বেশ কয়েকজন ভবনমালিক অবৈধভাবে রাস্তার জায়গা দখল করেছেন। এতে রাস্তার প্রশস্ততা কমে গেছে। অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করে প্রকৃত নকশা অনুযায়ী রাস্তা প্রশস্ত করতে হবে।

অন্যদিকে মেয়রের নির্দেশনা নিয়ে কাউন্সিলরদের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তিও রয়েছে। কয়েকজন কাউন্সিলর বলছেন, মেয়রের নির্দেশনা পুরোনো ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের জন্য নয়। নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের জন্য এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, ঢাকা উত্তর সিটিতে আগে ওয়ার্ড ছিল ৩৬টি। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে আরও ১৮টি ওয়ার্ড ঢাকা উত্তর সিটিতে যুক্ত হয়, যা আগে ৮টি ইউনিয়নের (বাড্ডা, ভাটারা, সাঁতারকুল, বেরাইদ, ডুমনি, উত্তরখান, দক্ষিণখান ও হরিরামপুর) অন্তর্ভুক্ত ছিল।

মহাখালী এলাকার ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. নাছির বলেন, ‘এটা (নির্দেশনা) আমাদের জন্য ছিল না। নতুন যেসব ওয়ার্ড যুক্ত হয়েছে, সেসব ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের নির্দেশটি দেওয়া হয়েছে।’

সিটি করপোরেশনে নতুন যুক্ত হওয়া ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের (সাবেক বাড্ডা ইউনিয়ন) কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম সেদিনের বোর্ড সভায় ছিলেন। তবে তিনি বলছেন, সেদিন মেয়র শুধু ফুটপাতের দখলকারীদের তালিকা দিতে বলেছিলেন। তবে তিনি কোনো তালিকা দেননি। এই কাউন্সিলর বলেন, তাঁর ওয়ার্ডে ফুটপাত আছে এমন কোনো সড়ক নেই।

সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, মেয়রের বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্য ছিল, রাস্তার দখলদারদের চিহ্নিত করা। দখল হওয়া রাস্তার তালিকা করা এবং সম্পত্তি বিভাগের সহযোগিতায় অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করা।

এদিকে মেয়রের নির্দেশনা অনুযায়ী তালিকা করেছেন বলে দাবি করেছেন ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাকির হোসেন। সেই তালিকা করপোরেশনে জমা দিয়েছিলেন কি না, সেটি তাঁর মনে নেই বলে প্রথম আলোকে জানান। তবে তালিকায় কতজন দখলদারের নাম রয়েছে, সেটি বলতে পারেননি তিনি।

দখলদারদের তালিকা করে বা দিয়েও কোনো লাভ হবে না বলে জানান একজন কাউন্সিলর। নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দখলদারদের তালিকা তৈরি করতে গেলে রাজনৈতিকভাবে নানা ঝামেলা হয়। আবার তালিকা করতে গেলে বা উচ্ছেদ করতে গেলে অনেক রাজনৈতিক নেতা ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের লোকজন দখলদারের পক্ষ নেয়। এমন পরিস্থিতিতে নামকাওয়াস্তে তালিকা করার কোনো মানে হয় না।

অন্যদিকে দখলদার চিহ্নিত করতে জরিপ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের (দক্ষিণখান) কাউন্সিলর আনিছুর রহমান। তিনি বলেন, কে কে রাস্তা দখল করেছে, সেটা তদন্ত করে বের করা সময়সাপেক্ষ।

বিভিন্ন ওয়ার্ডে রাস্তা ও ফুটপাত দখলমুক্ত করতে প্রায় নিয়মিতই অভিযান চালায় ঢাকা উত্তর সিটি। করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, মোহাম্মদপুরের ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের জাপান গার্ডেন সিটির সামনের সড়ক ও ফুটপাতে দোকান বসানো হয়। ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকা, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ের উল্টো দিকের এলাকা, উত্তরা ১ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন সড়কের জায়গা দখল করে ভ্রাম্যমাণ দোকান বসানো হয়।

এ ছাড়া বাড্ডা, বনানী, গুলশান, মহাখালী, খিলক্ষেত, তেজগাঁও শিল্প এলাকার রাস্তা দখল করে নানা ধরনের স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। এসব স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান চালানো হবে। বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ দখলদারদের সঙ্গে কিছু কাউন্সিলরও জড়িত।

রাস্তা দখলদারদের তালিকা জমা না দেওয়ার বিষয়ে মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তালিকা জমা দিতে কাউন্সিলরদের চিঠি দিয়ে এবার সময় বেঁধে দেওয়া হবে। কেউ নির্দেশনা না মানলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রাস্তা দখলমুক্ত করতে যা যা করা দরকার, এর সবই করা হবে।