ধ্বংস শুধু স্থাপনা নিশ্চিহ্ন করে দেয় এমন নয়, ইতিহাসও মুছে দেয়। এতে সভ্যতার ঐতিহ্য হারায়। একইভাবে কোনো মৃত্যু শুধু মানুষটির চলে যাওয়া নয়, মুছে যায় তাঁর সঙ্গে সম্পর্কিত বহু কিছু। অথচ ব্যক্তি-দল-রাষ্ট্র-সমাজ ও আদর্শের ওপর ভর করে আদিকাল থেকেই মানুষ হত্যা ও ধ্বংসে লিপ্ত। শিল্প সব সময় নন্দনতত্ত্বের কথা বললেও শিল্পীদের হাতেই কখনো কখনো তৈরি হয়েছে অস্ত্রের নকশা। বাধ্য হয়ে তাঁরাও কখনো জড়িয়েছেন হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে। তাই মৃত্যুর মতো নৃশংসতা থেকে বিচ্ছিন্ন নয় শিল্পীর নান্দনিকতাও। এই ভাবনা থেকে পাঁচজন শিল্পীর শিল্পকর্ম নিয়ে আয়োজন করা হয়েছে মৃত্যুদণ্ড (ডেথ সেনটেন্স) প্রদর্শনীর। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে রাজধানীর ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে শুরু হয়েছে এ প্রদর্শনী।
শিল্পী আনিসুজ্জামান সোহেল, ইমরান সোহেল, প্রমথেশ দাস, নাজমুন নাহার ও শিমুল দত্তের শিল্পকর্ম নিয়ে সাজানো হয়েছে প্রদর্শনী মৃত্যুদণ্ড (ডেথ সেনটেন্স)। অ্যাক্রেলিক, নিউ মিডিয়া, ভাস্কর্য, ভিডিও আর্ট, স্কাল্পচার, জলরং, ড্রয়িং, মৃৎশিল্পসহ বিভিন্ন মাধ্যমের প্রায় এক শ শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে। এর মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞের বিচিত্র রূপ। যেমন শিল্পী আনিসুজ্জামান সোহেলের ‘গোল্ডেন লিফ অন কংক্রিট’ শিল্পে স্থান পেয়েছে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সাতটি স্থাপনা ধ্বংসের চিত্র।
বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত সিরিয়ার আলেপ্পো শহরের বড় মসজিদটি তৈরি হয়েছিল অষ্টম ও ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যে। হাজার বছরের পুরোনো এ মসজিদের মিনারটি ২০১৩ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ চলাকালে ধ্বংস হয়। আফগানিস্তানের সিল্ক রোডে থাকা বামিয়ানের বুদ্ধ ছিল একসময় বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু বুদ্ধের মূর্তি। বুদ্ধমূর্তিটি ২০২১ সালে ধ্বংস করে তালেবান জঙ্গিগোষ্ঠী। গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপত্যগুলোকে উপস্থাপন শিল্পী তুলে ধরেছেন কংক্রিটের ওপর। এর জন্য শিল্পী ব্যবহার করেছেন গোল্ডেন লিফ পেপার বা সোনার পাতে তৈরি পাতলা কাগজ।
১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া প্রদর্শনী নিয়ে কয়েকবার কথা হয় এখানকার শিল্পীদের সঙ্গে। বেঙ্গল গ্যালারিতে শিল্পী আনিসুজ্জামান সোহেল এখানকার বিভিন্ন শিল্পকর্ম নিয়ে ব্যাখ্যা দিলেন প্রথম আলোর কাছে। নাজমুন নাহার কেয়ার শিল্পকর্ম ‘গানপাউডার’ সিরিজ দেখিয়ে তিনি বললেন, বুলেট চলার সময়ও একটি শব্দ হয়। সে শব্দের একটি মাত্রা আছে। সেই মাত্রাকে সংগীতের স্বরলিপির মাপে মেপে দেখাতে চেয়েছেন শিল্পী। যেন যে সুরে সংগীত হতে পারত, সেই মাত্রায় গর্জে উঠছে বুলেটের শব্দ। একই শিল্পীর আরেকটি কাজ ‘পাওয়ার প্লে’। সেখানে উঠে এসেছে আদিমকাল থেকে হত্যার বিভিন্ন রূপ ও ক্ষমতার গল্প।
শিল্পী প্রমথেশ দাস তৈরি করেছেন ‘টিকটক’ নামের শিল্পকর্মটি। তাতে বিভিন্ন মানচিত্রের ভেতর বন্দুক দিয়ে বানানো হয়েছে ঘড়ির কাঁটা। এই কাঁটা প্রতিমুহূর্তে টিকটক শব্দে জানান দিচ্ছে, এই মুহূর্তে কোথায় এখন যুদ্ধ চলছে। এভাবে শিল্পীদের সব শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মৃত্যু ও ধ্বংসের রূপ পরিবর্তনের ইতিহাস।
এই প্রদর্শনীর কিউরেটর জুয়েল এ রব বলেন, ‘বিভিন্ন কালে মানুষ যেভাবে যুদ্ধ, হত্যা ও ধ্বংসে মেতে উঠেছে, তা নিবিড় পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে মৃত্যুদণ্ড (ডেথ সেনটেন্স) প্রকল্পের মূল ভাবনা তৈরি হয়েছে। প্রস্তরযুগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং প্রসারকে কাজে লাগিয়ে বিবর্তিত হয়েছে মারণাস্ত্র ও হাতিয়ার।’ তিনি বলেন, সাধারণ দুর্বৃত্তের মনোহারি নকশার ছোরা থেকে শুরু করে সমকালের আগ্নেয়াস্ত্রের হাতলেও রয়েছে তেমন নকশা। পরবর্তীকালে জীবননাশক ইনজেকশন, হ্যান্ডগান, গ্রেনেড, মিসাইল, গ্যাসচেম্বার, পারমাণবিক বোমা, ইলেকট্রিক চেয়ারের মতো আরও কার্যকর ও ভয়ংকর উদ্ভাবন মানুষের এই উদগ্র আকাঙ্ক্ষাকে পরিতৃপ্ত করেছে। ফলে মৃত্যুর সঙ্গে শিল্পীরও সংযোগ রয়েছে।
দৃশ্য শিল্পকলার দায় কি মানুষের মনকে গভীরভাবে আলোড়িত ও বিমুগ্ধ করা, নাকি ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় হানাহানি ও হত্যার দোসর হওয়া—সে প্রশ্ন তুলেছেন কিউরেটর।
বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সাবেক পরিচালক প্রয়াত শিল্পী সুবীর চৌধুরী স্মরণে শুরু হওয়া বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের বৃত্তির আওতায় আয়োজন করা হয়েছে এই প্রদর্শনী। ২০১৫ সালে সুবীর চৌধুরী বৃত্তি প্রণয়ন করে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। এরই আওতায় ৫ জন শিল্পীর শিল্পকর্ম নিয়ে মৃত্যুদণ্ড (ডেথ সেনটেন্স) আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী চলবে ৩০ মার্চ পর্যন্ত। বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার (রোববার ছাড়া) বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত প্রদর্শনী দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।