নিম্ন আয়ের মানুষের আবাসন নয়, অফিসার্স কোয়ার্টার তৈরিতে ব্যস্ত সরকার: বিআইপি

নগর–পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স আয়োজিত ‘নগরে সকলের জন্য নিরাপদ আবাসন’ শীর্ষক পরিকল্পনা সংলাপ। ঢাকা, ১১ অক্টোবর
ছবি: প্রথম আলো

সরকার নিম্ন আয়ের মানুষের নিরাপদ আবাসনব্যবস্থা উন্নয়নে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না; বরং অধিকাংশ বরাদ্দ ব্যয় হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসন বা অফিসার্স কোয়ার্টার নির্মাণে। আবাসন কেবল মাথা গোঁজার জায়গা নয়, এটি মানুষের নিরাপত্তা, মর্যাদা, স্বাস্থ্য ও জীবিকার ভিত্তি, যা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

আজ শনিবার দুপুরে রাজধানীর বাংলামোটরে নগর–পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) আয়োজিত ‘নগরে সকলের জন্য নিরাপদ আবাসন’ শীর্ষক পরিকল্পনা সংলাপে বক্তারা এ মতামত দেন। সংলাপে সভাপতিত্ব করেন বিআইপির সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান এবং সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান।

শুভেচ্ছা বক্তব্যে শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, ঢাকায় ২০ শতাংশ অধিবাসী জমির মালিক ও ৮০ শতাংশ ভাড়াটে। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মানুষ বস্তিতে থাকে, যা নগরের আবাসন বৈষম্যকে স্পষ্ট করে।

সবার জন্য আবাসন কেবল নীতি নয়, এটি সামাজিক ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা ও মানবিক মর্যাদার প্রশ্ন
আকতার মাহমুদ, অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইপির উপদেষ্টা পরিষদের আহ্বায়ক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘আবাসন শুধু মাথা গোঁজার ঠাঁই নয়, এটি মানুষের নিরাপত্তা, মর্যাদা, স্বাস্থ্য ও জীবিকার ভিত্তি। আমাদের সংবিধান নাগরিকের মানসম্মত গৃহায়ন নিশ্চিত করাকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে নির্ধারণ করেছে।’

অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, রিয়েল এস্টেট খাত দেশের জিডিপিতে ৭ থেকে ৮ শতাংশ অবদান রাখলেও তা মূলত উচ্চবিত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সাশ্রয়ী আবাসনে এই খাতকে যুক্ত করতে সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারত্বভিত্তিক মডেল, অন্তর্ভুক্তিমূলক আবাসন ভর্তুকি ও ভাড়াভিত্তিক উন্নয়ন কার্যক্রম প্রয়োজন।

এই নগর–পরিকল্পনাবিদের ভাষ্য, বাংলাদেশের আবাসন খাতের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো ভূমির অভাব, জমির উচ্চমূল্য, নির্মাণের ব্যয় বৃদ্ধি, সাশ্রয়ী ঋণের ঘাটতি ও সরকারি পরিকল্পনার ধারাবাহিকতার অভাব। তিনি বলেন, সবার জন্য আবাসন কেবল নীতি নয়, এটি সামাজিক ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা ও মানবিক মর্যাদার প্রশ্ন।

বিআইপি সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, মানুষের শিক্ষা, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার আগে আবাসনের অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি নিম্ন আয়ের মানুষ অথচ তাদের জন্য নিরাপদ আবাসনের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই, যা অত্যন্ত হতাশাজনক। তিনি বলেন, সরকারের আবাসন নীতিমালায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তত ২০ শতাংশ ইউনিট নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সংরক্ষণের বিধান থাকা উচিত। ঢাকাকেন্দ্রিক হাউজিং মডেল থেকে সরে এসে সারা দেশব্যাপী ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন প্রয়োজন।

সংলাপে বিআইপির কোষাধ্যক্ষ মোসলেহ উদ্দীন হাসান বলেন, রিয়েল এস্টেট ব্যবসা এখনো সারা দেশে নয়, মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক, যা হতাশাজনক। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও সুষম উন্নয়নের জন্য এই খাতকে বিকেন্দ্রীকরণ করা জরুরি।

সরকারের আবাসন নীতিমালায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তত ২০ শতাংশ ইউনিট নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সংরক্ষণের বিধান থাকা উচিত
আদিল মুহাম্মদ খান, অধ্যাপক, পরিকল্পনাবিদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রাশেদা রওনক খান বলেন, ভাষানটেকসহ বিভিন্ন সরকারি আবাসন প্রকল্প দরিদ্র ও গৃহহীন জনগোষ্ঠীর জন্য নেওয়া হলেও জটিল প্রশাসনিক প্রক্রিয়া, দুর্নীতি ও মধ্যস্থতাভোগীদের কারণে প্রকৃত উপকারভোগীরা কাঙ্ক্ষিত সুবিধা পাচ্ছেন না।

বিআইপি উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সালমা এ শফী বলেন, খাসজমিতে পুনঃ উন্নয়নের মাধ্যমে উচ্চ ভবন নির্মাণ করে বৈষম্য দূর করা ও সহজলভ্য আবাসন নিশ্চিত করা সম্ভব। এ জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সঙ্গে বিআইপি ও রিহ্যাবকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন রিহ্যাবের সহসভাপতি প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাশফিয়া নাহরিন, বিআইপির সাবেক সহসভাপতি পরিকল্পনাবিদ আরিফুল ইসলাম, যুগ্ম সম্পাদক তামজিদুল ইসলাম প্রমুখ।