‘মেট্রোর’ পরশে বদলে যাওয়া মিরপুর

মেট্রোরেলের প্রভাবে জমজমাট হয়ে উঠেছে মিরপুর এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য। গড়ে উঠছে একের পর এক বিপণিবিতানসহ নামীদামি ব্র্যান্ডের দোকান। গতকাল মিরপুর-১২ নম্বর এলাকায়ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

মোহাম্মদ সালাউদ্দিন (৫৫) ১৯৯৬ সালে ভোলা থেকে ঢাকায় ব্যবসার আশায় এসেছিলেন। বর্তমানে পল্লবী আবাসিক এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা। তিনি বলেন, ‘সেই সময় পল্লবীতে বহুতল ভবন বলতে ছিল কয়েকটি গার্মেন্টস কারখানা। তিন দশকে গোটা মিরপুর বহুতল ভবনে ভরে গেছে। মেট্রোরেলের কারণে পুরো এলাকা এখন বাণিজ্যিক জোনে পরিণত হয়েছে, যোগাযোগব্যবস্থা যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি ব্যবসাও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।’

সম্প্রতি মিরপুর ২, ১০, ১১ ও পল্লবী এলাকা ঘুরে সালাউদ্দিনের কথার সত্যতা পাওয়া গেল। আধুনিক হাসপাতাল, শপিং মল, সিনেপ্লেক্স, ক্যাফে ও রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কারণে স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে।

নতুন রূপে সনি স্কয়ার

মিরপুরের ঐতিহ্যবাহী সনি স্কয়ার আজ ঢাকার অন্যতম লাইফস্টাইল হাব হিসেবে পরিচিত। ১৯৮০-এর দশকে এটি গার্মেন্টস কারখানা হিসেবে নির্মিত হলেও পরে ‘সনি সিনেমা হল ও মার্কেট’ হিসেবে পরিচিতি পায়। ঢাকাই সিনেমার দুঃসময়ে সনি হল দর্শক হারায়। সঙ্গে ভবনটিও হারিয়ে যায় বিস্মৃতির অতল গহ্বরে।

২০২১ সালে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে এটি ফিরে পেয়েছে নতুন রূপে। এখন ঝকঝকে করপোরেট অফিস, শপিং জোন, ফুড কোর্ট, ছাদ রেস্তোরাঁ, আধুনিক সিনেপ্লেক্সসহ একাধারে বিনোদনের জায়গা।

সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো ভবনের পুরোনো গার্মেন্টস কারখানার স্পাইরাল র‍্যাম্পটি সংরক্ষণ করা হয়েছে, যা কালো কাচ ও মনোরম আলোকসজ্জায় নতুন প্রাণ পেয়েছে।

মিরপুরের ব্যবসা-বাণিজ্য বদলে গেছে মেট্রোরেলের প্রভাবে। বুধবার মিরপুর–১ নম্বরে সনি সিনেমা হল এলাকায়
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

স্থানীয় ব্যবসায়ী রাজু আহম্মেদ, যিনি ১৯৮২ থেকে মিরপুর-২ নম্বরে বাস করেন। তিনি বলেন, ‘১৯৮৬ সালে সনি হল চালু হলে ব্যবসার প্রসার এবং মানুষের সমাগম বাড়তে থাকে। হল বন্ধ হওয়ার পর গুরুত্ব কমে যায়। এখন আবার মেট্রোরেলের ছোঁয়ায় জমজমাট হচ্ছে এলাকা। এটি এখন মিরপুরের নতুন কেন্দ্র।’

সনি স্কয়ার ঘিরে গড়ে উঠেছে রুহানী মার্কেট, রূপায়ণ টাওয়ার, মিরপুর নিউমার্কেট, মাল্টিপ্ল্যান রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, এ আর টাওয়ারসহ বহুতল বাণিজ্যিক ভবন। সকাল থেকে রাত অবধি এই চত্বর জমে ওঠে কেনাকাটা, খাবার ও বিনোদনের উদ্দেশ্যে আসা মানুষের ভিড়ে। বৃহত্তর মিরপুরবাসীর লাইফস্টাইলের কেন্দ্র এখন সনি স্কয়ার।

মিরপুর-১০: বাণিজ্যের নতুন কেন্দ্র

মেট্রোরেল নেটওয়ার্কের মাঝামাঝি অবস্থানে অবস্থিত মিরপুর ১০। শেওড়াপাড়া থেকে পল্লবী পর্যন্ত পাঁচটি স্টেশনের মাঝামাঝি এই এলাকা মেট্রোরেলের সহজ যাতায়াতের সুবাদে বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।

আশপাশের সড়কজুড়ে গড়ে উঠেছে আধুনিক শপিং মল, রেস্তোরাঁ ও ক্যাফে। মিরপুর ১৩ ও মিরপুর ২ অভিমুখে নতুন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, ঝকঝকে শপিং আউটলেট ও ক্যাফে দেখা যায়।

মেট্রোরেল–সংলগ্ন এফএস স্কয়ার শপিং কমপ্লেক্সের ছায়াঘেরা ছাতিমগাছের নিচে বসে ছিলেন গার্মেন্টস কর্মকর্তা সফিকুল হাসান। তিনি বললেন, ‘মেট্রোরেলের কারণে মিরপুর-১০ ব্যবসার নতুন কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। সবুজ চত্বরটি ক্লান্তি কাটানোর আদর্শ স্থান।’

এই কমপ্লেক্সে পোশাক, মোবাইল, জুয়েলারি, ইলেকট্রনিকসসহ নানা পণ্যের নামীদামি ব্র্যান্ডের আউটলেট রয়েছে।

মিরপুর অরিজিনাল ১০ ও ১১ নম্বর এলাকায় গার্মেন্টস এক্সেসরিজ, খাদ্যদ্রব্য, রেস্তোরাঁ, খুচরা বাণিজ্য, আধুনিক অফিস ভবন ও বেসরকারি হাসপাতালও গড়ে উঠেছে।

নস্টালজিয়া ও নতুন পল্লবী

একসময় পল্লবী ছিল নিরিবিলি ও ছিমছাম আবাসিক এলাকা। সন্ধ্যা নামলেই রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত। তখন এলাকার প্রাণকেন্দ্র ছিল ‘পল্লবী হল’। সিনেমার টিকিট কাটার দীর্ঘ লাইন, ব্ল্যাকারদের দাপট, চানাচুর বিক্রেতা ও বইপত্র বিক্রির দোকান—সব মিলিয়ে গড়ে উঠেছিল এক আলাদা সাংস্কৃতিক পরিবেশ।

পূরবী হলের পাশে ১৯৮২ সাল থেকে মুদিদোকান চালান মোহাম্মদ হান্নান। স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, ‘মর্নিং শো থেকে লেট নাইট—কত মানুষ ভিড় করত! এখন চারপাশ ঝকঝকে, কিন্তু সেসব সিনেমাপাগল মুখগুলো খুব মিস করি। হলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা সময় এখান থেকে হারিয়ে গেছে।’

বর্তমানে পল্লবী বৃহত্তর মিরপুরের অন্যতম বাণিজ্যিক ও জনসমাগমপূর্ণ অঞ্চল। মেট্রোরেলের সরাসরি সংযোগ এই পরিবর্তনকে করেছে আরও গতিশীল।

পল্লবীর প্রধান সড়ক ঘেঁষে গড়ে উঠেছে শপিং কমপ্লেক্স, ক্যাফে, অফিস ও হাসপাতাল। মিরপুর ডিওএইচএস, রূপনগর, আরামবাগ, আলুব্দী আবাসিক এলাকাকে কেন্দ্র করে পল্লবী এখন একটি সুসংগঠিত বাণিজ্যিক জোনে পরিণত হয়েছে।

এলাকাজুড়ে রয়েছে একাধিক শপিং সেন্টার, নামীদামি পোশাকের ব্র্যান্ড, খাবারের দোকান, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও হাসপাতাল। সবজি, মাছ, মুদি পণ্য, কসমেটিকস থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিকস—সবই পাওয়া যায় এক ছাদের নিচে।

ওয়ালটন, সিঙ্গার, ভিশন, এলজি-বাটারফ্লাইয়ের মতো প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের শোরুমও রয়েছে পল্লবীতে। খাবারের দোকানে এসেছে বৈচিত্র্য। ফাস্ট ফুডের রমরমা ব্যবসার পাশাপাশি দেশি থেকে চায়নিজ, কাবাব-বিরিয়ানি পর্যন্ত সব ধরনের খাবার পাওয়া যায় এলাকাটিতে। স্বাস্থ্যসেবার দিক থেকেও পল্লবী বদলে গেছে। একাধিক হাসপাতাল, ফার্মেসি, ডেন্টাল ক্লিনিক, প্যাথলজিক্যাল ল্যাব এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে আছে।

মূলত ঢাকা শহরের একসময়ের শহরতলি মিরপুর আমূল বদলে গেছে। অতীতের নস্টালজিয়া আর আধুনিকতার ছোঁয়া মিলেমিশে ফুটে উঠেছে নতুন দিনের ঢাকার এক প্রাণবন্ত ছবি। মেট্রোরেলের ছোঁয়ায় এই স্থান হয়ে উঠেছে নগরবাসীর নতুন ঠিকানা। যেখানে জীবনের গতি আর রং এক অন্য আবহ তৈরি করেছে।