রিকশাচিত্রশিল্পীদের অনুকরণে দেয়ালে ছবি এঁকেছেন চারুকলার শিল্পীরা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের দেয়ালে রিকশাচিত্রশিল্পীদের অনুকরণে আঁকা ছবিগুলো নজর কাড়ছে সবারছবি: সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

সম্মান বয়ে আনা যেকোনো কিছুই গর্বের। সেই সুন্দর সত্যটি এবার ফুটে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের দেয়ালে। একদিকে শোভাযাত্রার শিল্পকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে। অন্যদিকে শোভাযাত্রার ব্যয়নির্বাহের জন্য হচ্ছে তৈরি হচ্ছে লোকশিল্পের কাজ। তবে এর মধ্যে বিশেষভাবে সবার নজর আটকে যাচ্ছে রঙিন দেয়ালের দিকে। গত বছর এখানে রঙের প্রাধান্য কম রেখে ছবি আঁকা হয়েছিল। এক বছরে শাহবাগ-টিএসসি যাতায়াতকারীদের দৃষ্টি এতেই অভ্যস্ত ছিল।

চারুকলা অনুষদের দেয়ালে আঁকা রিকশাচিত্র
ছবি: সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

এখন চারুকলা অনুষদ অতিক্রম করতে গেলে হঠাৎ করে চোখে লাগবে অনেকটা রঙের সমাহার। এই দেয়ালে চারুকলার শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা আঁকছেন বংলাদেশের রিকশাচিত্রশিল্পের ছবি। এককালে রিকশাচিত্রশিল্পীদের হাতে আঁকা অনিপুণ ছবিগুলোই আঁকা হচ্ছে সেই ধারা বহাল রেখে। শুক্রবার বিকেলে দেখা যায় এখানে রিকশাচিত্রশিল্পের একটি ছবি হাতে নিয়ে বসে সেটা দেখে দেখে ছবি আঁকছেন শিল্পী।
কদিন ধরে এখানে রশি দিয়ে আটকে প্রবেশাধিকার সীমিত করে কাজ করছিলেন শিল্পীরা। কাজ শেষ হয়েছে শুক্রবার রাতে। শনিবার দুপুরে খুলে দেওয়া হয়েছে রশি।

মোট ২৮টি বড় চিত্রকর্ম, ২১টি পিলারের নকশাসহ পুরো দেয়ালজুড়েই আঁকা হয়েছে রিকশাশিল্পের কাজ। যেমন রিকশার পাদানি অথবা ঢালে যেমন ছোট ছোট পানপাতার নকশা করা হয়, তেমন নকশা বসানো হয়েছে বর্ডার হিসেবে। ছোট পিলারে আছে লতানো ফুল। আর দেয়ালের ছবিগুলোতে গুরুত্ব পেয়েছে জনপ্রিয় রিকশাচিত্রকর্ম।

যেমন টেবিল–চেয়ারে বসে থাকা বাঘ, রিকশা চালানো সিংহ, বেদের মেয়ে জোসনার মতো জনপ্রিয় সিনেমার পোস্টার, নকশার মধ্যে লেখা ‘মা’ শব্দটির গুরুত্ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ‘লেটারিং’ প্রাধান্য দিয়ে। রীতিমতো চলমান এক বিশাল ক্যানভাসের রিকশাচিত্র হয়েছে এটি।

হরিণ চালাচ্ছে রিকশা! আর সওয়ারি কিনা সিংহ! চারুকলা অনুষদের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে এই চিত্র
ছবি: সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

চারুকলা অনুষদের ডিন শিল্পী নিসার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বছর বাংলাদেশের রিকশাচিত্রশিল্প ইউনেসকোর স্বীকৃতি পেয়েছে। সে ভাবনা থেকেই চারুকলার দেয়াল ও স্কুলঘরে এবার রিকশাচিত্রশিল্প আঁকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
শনিবার চারুকলা অনুষদে গিয়ে দেখা যায়, ভেতরের স্কুল ঘরেও চলছে রঙের কাজ। সেখানেও হবে রিকশাচিত্রশিল্পের কাজ। অনুষদের প্রবেশপথে লোহার গেটে লেখা ‘স্বাগত’ শব্দটিও লেখা হয়েছে এই মোটিফে।

এ কাজ রিকশাচিত্রশিল্পীদের দিয়ে করানো যেত কি না, জানতে চাইলে নিসার হোসেন বলেন, ‘রিকশাচিত্রশিল্পীদের সংখ্যা অনেক কম। এ ছাড়া তাঁদের নিজেদেরও অনেক ব্যস্ততা থাকে। তাই চারুকলার শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই করছেন কাজটি।’

শিয়াল পণ্ডিত চলছে চোখে চশমা আর হাতে লাঠি নিয়ে! খরগোশ বাজাচ্ছে ভেঁপু আর বিশাল পরাক্রমশালী বাঘ কিনা বাজাচ্ছে ঢোল!
ছবি: সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

গত ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ঢাকা শহরের ‘রিকশা ও রিকশাচিত্র’। এরপর রিকশাচিত্রশিল্পীদের কাজ নিয়ে প্রদর্শনী হয়েছে। বইমেলার স্টলে স্থান পেয়েছে রিকশাচিত্রশিল্প।

বাংলাদেশে ষাট থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত শত শত রিকশাচিত্রশিল্প আঁকা হয়েছে। এর মধ্য থেকে চারুকলার দেয়ালে আঁকা এই ছবিগুলো কোন প্রক্রিয়ায় নির্বাচন করা হয়েছে, জানতে চাইলে চারুকলা অনুষদের ২৫তম অনার্স ব্যাচের শিক্ষার্থী তাসফিয়া মুশাররাত চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, চারুকলার শিক্ষক নিসার হোসেন, শিশির ভট্টাচার্য্য, সুমন বৈদ্য, অমিত নন্দী, মলয় বালা, ছোটন সাহার মতো অনেক শিক্ষক এই চিত্রকর্মের দায়িত্ব নিয়ে শিক্ষার্থীদের তত্ত্বাবধান করছেন। যত চিত্রকর্মের ছবি আছে, সেসব গুছিয়ে এক জায়গায় করে সেখান থেকে নির্বাচিত করা হয়েছে কয়েকটি ছবি। সেসবই দক্ষ শিল্পীরা এঁকে ফুটিয়ে তুলছেন দেয়ালের গায়ে।

চারুকলার দেয়ালের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে দেখা গেল অনেক রকম বৈচিত্র্যময় নকশা। শিয়াল পণ্ডিত চলছে চোখে চশমা আর হাতে লাঠি নিয়ে। খরগোশ বাজাচ্ছে ভেঁপু আর বিশাল পরাক্রমশালী বাঘ কিনা বাজাচ্ছে ঢোল। পাশের এক ছবিতে দেখা গেল হরিণ চালাচ্ছে রিকশা আর সওয়ারি হয়েছে সিংহ। এমন অনেক নকশার মধ্যে একটিতে লেখা আছে ‘ঢাকা বাংলাদেশ’। দুপাশ থেকে উঠে এসেছে দুই নীল ময়ূর। তাদের মাঝখানে ঠাঁই পেয়েছে বাঘের মুখ। এরই নিচে লেখা আছে ১৪৩১।

আসছে নতুন বাংলা বছরকে স্বাগত জানাতেই দেয়ালে দেয়ালে এবারের এই শিল্পকর্ম। যেখানে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের এক অর্জনের ইতিহাসও।