পানিনিষ্কাশনে হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি: ৯০ ভাগ এলাকা স্থাপনা–আচ্ছাদিত হতে পারে ২০৪০ সালের মধ্যে  

হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি ছাড়াও রাজধানীর পানিনিষ্কাশনের আরও ছয়টি পথ আছে। সেগুলো হলো কল্যাণপুর খাল ও এর আশপাশের এলাকা, গোড়ান চটবাড়ি এলাকা, বোয়ালিয়া খাল, শাহজাদপুর-ডুমনি খাল, সুতিভোলা-বেগুনবাড়ি-নড়াই খাল এবং সেগুনবাগিচা-জিরানি-খিলগাঁও-বাসাবো ও মান্ডা খাল।

রাজধানীবাসীর জীবনে যেন বিভীষিকা নিয়ে এসেছিল গত ২১ সেপ্টেম্বরের বর্ষণ। ওই দিন ঢাকায় টানা ছয় ঘণ্টায় বৃষ্টি হয় ১২২ মিলিমিটার। এতে অনেক সড়ক ঘণ্টার পর ঘণ্টা জলাবদ্ধ হয়ে থাকে। কোমর সমান পানি পেরিয়ে বাসায় ফেরেন অনেকে। কয়েক কিলোমিটার পথ পেরিয়ে ঘরে ফিরতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যায় কারও কারও। নগরবিদেরা বলছেন, ঢাকার পানিনিষ্কাশনব্যবস্থায় ত্রুটির কারণেই এ অবস্থা হয়েছে।

রাজধানীর পানিনিষ্কাশনের যতগুলো পথ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি এলাকা। এই এলাকার বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ অবস্থা নিয়ে এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৪০ সালের মধ্যে এখানকার ৯০ শতাংশের বেশি এলাকা স্থাপনা দিয়ে আচ্ছাদিত হয়ে যেতে পারে। তখন এই এলাকায় ফাঁকা জায়গা থাকবে ১০ শতাংশেরও কম।  এই পথ দিয়ে তখন পানিনিষ্কাশন কঠিন হয়ে পড়বে।

‘দ্য নিড ফর ট্রান্সফরমেটিভ চেঞ্জ ইন ঢাকাস স্টর্মওয়াটার ড্রেনেজ সিস্টেম: গ্রিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড নেচার-বেসড অ্যাপ্রোচেস ফর সাসটেইনেবল সলিউশন’ শীর্ষক এ গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মুজিবুর রহমান। আজ মঙ্গলবার রাজধানীতে অনুষ্ঠেয় এক সেমিনারে এ গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরা হবে।

হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ির প্রায় ৭১ বর্গকিলোমিটার এলাকার ওপর এ গবেষণা করা হয়েছে। গবেষণার উদ্দেশ্য সম্পর্কে পানিবিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজধানীর পানিনিষ্কাশনের সবচেয়ে কার্যকর যে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ পথ আছে, তার মধ্যে হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি একটি। বলা যায়, এটি সবচেয়ে বড় এলাকা। এখানে এখন যে হারে স্থাপনা নির্মাণ শুরু হয়েছে, তা রোধ না করা হলে এবং সুপরিকল্পিত না হলে পরিস্থিতি কী হবে, সেটিই গবেষণার মাধ্যমে তুলে ধরতে চেয়েছি।’ তিনি বলেন, সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে এই পথে পানিনিষ্কাশন দূরহ হয়ে পড়বে, এ কাজে ব্যয়ও বাড়বে অনেক বেশি। বলা যায়, রাজধানীর পানি নিষ্কাশনের সাতটি পথের মধ্যে এই পথটি এখন বিপদের মুখে।

গবেষণায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি এলাকার প্রায় ৬৯ শতাংশ এখন স্থাপনা–আচ্ছাদিত হয়ে গেছে।  ২০২৫ সালের মধ্যে বাড়িঘর ও অন্যান্য স্থাপনায় আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ দাঁড়াবে ৭১ শতাংশের বেশি। আর ২০৪০ সালের মধ্যে আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ হতে পারে ৯০ শতাংশের বেশি।

এলাকাটির জন্য বিশেষ বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) বাস্তবায়ন করা হবে। সেখানে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে বলে আশা করা যায়। তাই গবেষণায় যে অনুমান করা হয়েছে, বাস্তবে তা না-ও হতে পারে।
ইকবাল হাবীব, রাজউক নগর উন্নয়ন কমিটির সদস্য

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী ১৭ বছরের মধ্যে হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি এলাকার জলাভূমি বা জলাশয় এলাকা কমে হয়ে যেতে পারে সাড়ে ৩ শতাংশের মতো। আর উন্মুক্ত এলাকা থাকতে পারে ৬ শতাংশের মতো। অর্থাৎ সব মিলিয়ে প্রায় ১০ শতাংশ উন্মুক্ত এলাকা থাকবে।

গবেষণার ক্ষেত্রে ১৯৮৯, ১৯৯৯ এবং ২০০৯ সালের হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি এলাকার উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি ২০১৩ সালের ভূমি ব্যবহারের ডিজিটাল মানচিত্র বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এসবের বিশ্লেষণের মাধ্যমেই ২০৪০ সালের মধ্যে এ এলাকার পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে বলে জানান অধ্যাপক মুজিবুর রহমান।

হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি ছাড়া রাজধানীর পানিনিষ্কাশনের আরও ছয়টি পথ আছে। সেগুলোর মধ্যে আছে কল্যাণপুর খাল ও এর আশাপাশের এলাকা, গোড়ান চটবাড়ি এলাকা, বোয়ালিয়া খাল, শাহজাদপুর-ডুমনি খাল, সুতিভোলা-বেগুনবাড়ি-নড়াই খাল এবং সেগুনবাগিচা-জিরানি-খিলগাঁও-বাসাবো ও মান্ডা খাল।

অধ্যাপক মুজিবুর রহমান

গবেষণায় হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি এলাকায় যে পরিমাণ স্থাপনা-আচ্ছাদিত স্থানের কথা বলা হয়েছে, বাস্তবে এমন এলাকা আরও কম বলে মনে করেন নগরবিদ ইকবাল হাবীব। তিনি বলেন, এ এলাকার স্থাপনার একটি উল্লেখযোগ্য অংশে অস্থায়ী স্থাপনা আছে। এসব স্থাপনা তুলে দিতে রাজউক সম্প্রতি তৎপর হয়েছে।

ইকবাল হাবীব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নগর উন্নয়ন কমিটিতে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) পক্ষে সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, ‘এলাকাটির জন্য বিশেষ বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) বাস্তবায়ন করা হবে। সেখানে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে বলে আশা করা যায়। তাই গবেষণায় যে অনুমান করা হয়েছে, বাস্তবে তা না–ও হতে পারে।’

ঢাকার মতো একটি জটিল এলাকার জন্য যে নগর-পরিকল্পনা হওয়া দরকার তা নেই। এই পরিকল্পনা অনিয়ন্ত্রিত এবং অপরিণামদর্শী। তাই পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা মোটেও কার্যকর হচ্ছে না।
আদিল মুহাম্মদ খান, নির্বাহী পরিচালক, ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট

রাজধানীর পানিনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিয়ে একাধিক গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি অবশ্য এ গবেষণার যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা বাস্তবসম্মত বলেই মনে করেন। তিনি বলেন,  ‘ঢাকার মতো একটি জটিল এলাকার জন্য যে নগর–পরিকল্পনা হওয়া দরকার তা নেই। এই পরিকল্পনা অনিয়ন্ত্রিত এবং অপরিণামদর্শী। তাই পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা মোটেও কার্যকর হচ্ছে না।’

হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি এলাকার বর্তমান উন্নয়ন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আদিল মুহাম্মদ খানের কথা, এখানে সামষ্টিক স্বার্থ নয় বরং ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে উন্নয়ন হচ্ছে। এর ফলে স্থাপনা–আচ্ছাদিত এলাকা বাড়ছে এবং তা বাড়তেই থাকবে।