অনুমোদন পার্কিংয়ের, দোকান রাসায়নিকের

২২০৪টি ভবনের বেজমেন্ট পরিদর্শন করে ৭৫০টিতে বাণিজ্যিক ব্যবহার পাওয়া গেছে। ১৯৪৪টি ভবনের নকশা দেখাতে পরেননি ভবনমালিকেরা।

পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারে বহুতল ভবন বিস্ফোরণের স্থল। গত শনিবার তোলা।
ছবি: প্রথম আলো

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওতাধীন এলাকার মোট ভবনগুলোর বেজমেন্টের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ দোকান, মার্কেটসহ নানা ধরনের বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। সম্প্রতি রাজউকের সরেজমিন পরিদর্শনে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এর মাধ্যমে সিদ্দিক বাজারের মতো দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত ৭ মার্চ বিকেলে রাজধানীর সিদ্দিক বাজারের একটি সাততলা ভবনে বিস্ফোরণ হয়। এরপর রাজউক এর আওতাধীন এলাকার অন্য ভবনগুলোর বেজমেন্ট পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বেজমেন্ট আছে শুধু এমন ভবনে পরিদর্শন করা হয়েছে। কিন্তু সব ভবন পরিদর্শনের আওতায় আসেনি।

শুধু পরিদর্শন না করে, নিয়মের ব্যত্যয় পেলে ভবনমালিকদের বিরুদ্ধে জরিমানাসহ কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে শুধু পরিদর্শন করে লাভ হবে না।
শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান, সাধারণ সম্পাদক, বিআইপি

সিদ্দিক বাজারের সাততলা ওই ভবনের অনুমোদন ছিল পাঁচতলা পর্যন্ত। বেজমেন্টে গ্যাস জমে ওই ভবনে বিস্ফোরণ ঘটেছিল বলে মনে করা হয়।

রাজউকের আওতাধীন এলাকা ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার। এলাকাটি ৮টি অঞ্চলে বিভক্ত। রাজউকের এক অফিস আদেশ অনুযায়ী, প্রতিটি অঞ্চলে তিনটি করে কমিটির মাধ্যমে মোট ২৪টি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ১০ মার্চ থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত রাজউক এলাকা পরিদর্শন করে।

গত ৩০ মার্চ জমা দেওয়া পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ সময়ে ২ হাজার ২০৪টি ভবন পরিদর্শন করেছেন রাজউকের কর্মকর্তারা। এর মধ্যে ৭৫০টি ভবনের বেজমেন্ট পার্কিং হিসেবে ব্যবহার না করার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৬৮৩টি ভবনের বেজমেন্টে দোকান ও গুদাম পেয়েছে পরিদর্শন কমিটি। দোকানের মধ্যে দাহ্য পদার্থের (রাসায়নিক) দোকানও আছে। তবে ঠিক কতটি ভবনে দাহ্য পদার্থের দোকান আছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে রাজউক থেকে তাঁদের কাছে এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। তবে নাম না প্রকাশের শর্তে রাজউকের আরেকজন অথরাইজড অফিসার বলেন, শিগগিরই এ ব্যাপারে একটি সভা করবে রাজউক। সভা করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
মাকিদ এহসান, সংস্থাটির অথরাইজড অফিসার

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান প্রথম আলোকে বলেন, রাজউকের বিধি অনুযায়ী, বেজমেন্ট মূলত পার্কিং হিসেবে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু অনেক বাণিজ্যিক ভবনেই পার্কিংয়ের জায়গাটি যানবাহন রাখার পাশাপাশি গুদামসহ নানা কাজে ব্যবহার করা হয়।

এতে ছোট একটি দুর্ঘটনা ঘটলে তা মুহূর্তেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এতে ভবনের ব্যবসায়ী, ভাড়াটেসহ সাধারণ মানুষ বা ক্রেতার জানমালের ক্ষতি হতে পারে। তাই শুধু পরিদর্শন না করে, নিয়মের ব্যত্যয় পেলে ভবনমালিকদের বিরুদ্ধে জরিমানাসহ কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে শুধু পরিদর্শন করে লাভ হবে না।

সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণের শিকার ভবনটি রাজউকের অঞ্চল ৫–এর আওতায় পড়েছে। এ অঞ্চলে মোট ৪০৩টি ভবন পরিদর্শন করেছে কমিটি। এর মধ্যে ১৭৯টি ভবনের বেজমেন্টে দাহ্য পদার্থের দোকান, গুদাম বা মার্কেট হিসেবে ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

ভবনমালিকদের নকশার জন্য নোটিশ দেওয়া হবে। নকশা পেলে বেজমেন্টের অনুমোদিত ব্যবহার সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
মোবারক হোসেন, রাজউকের পরিচালক (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ-১)

বেজমেন্টের বাণিজ্যিক ব্যবহার সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে পুরান ঢাকা ও কেরানীগঞ্জ নিয়ে গঠিত অঞ্চল-৭–এ। এ অঞ্চলে ২৮৬টি ভবন পরিদর্শন করে ২৪১টি ভবনের বেজমেন্টেই বাণিজ্যিক ব্যবহার দেখা গেছে।

বেজমেন্টের বাণিজ্যিক ব্যবহারের বিষয়ে রাজউক কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, জানতে চাইলে সংস্থাটির অথরাইজড অফিসার মাকিদ এহসান প্রথম আলোকে বলেন, পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে রাজউক থেকে তাঁদের কাছে এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। তবে নাম না প্রকাশের শর্তে রাজউকের আরেকজন অথরাইজড অফিসার বলেন, শিগগিরই এ ব্যাপারে একটি সভা করবে রাজউক। সভা করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।

পরিদর্শনকালে নকশা পায়নি রাজউক

সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণের শিকার ভবনটির নকশা এখনো খুঁজে পায়নি রাজউক। আর এ বিস্ফোরণের পর রাজউকের বেজমেন্টের ব্যবহার জানতে যেসব ভবন পরিদর্শন করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ১ হাজার ৯৪৪টি ভবনের নকশা তাৎক্ষণিকভাবে ভবনমালিকেরা রাজউকের পরিদর্শন দলকে দেখাতে পারেননি। ২৬০টি ভবনের নকশা তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া গেছে। এখন সংশ্লিষ্ট ভবনমালিকদের কাছ থেকে ভবনের নকশা চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি।

এর আগে ২০১৯ সালের মার্চে বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের পরও রাজউক এলাকার বহুতল ভবন পরিদর্শন করেছিল। পরিদর্শনে রাজউক এলাকায় ১ হাজার ৮১৮টি বহুতল ভবন (১০ তলার ওপর) পেয়েছিল সংস্থাটি।

যার ৮৪ শতাংশই নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল। আর ৭০ শতাংশ ভবনে কোনো অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা ছিল না। আর ওই সময় ৪৭৪টি বহুতল ভবনের নকশা পাওয়া যায়নি।

জানতে চাইলে রাজউকের পরিচালক (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ-১) মোবারক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ভবনমালিকদের নকশার জন্য নোটিশ দেওয়া হবে। নকশা পেলে বেজমেন্টের অনুমোদিত ব্যবহার সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।