‘আলপিন থেকে এলিফ্যান্ট, সবই পাওয়া যায়’

মাঠের চারপাশজুড়ে রয়েছে কড়াই, কৃষ্ণচূড়াগাছের সারি। সবুজ ছায়ায় মাঠজুড়ে চলছে বিকিকিনি। পাখির চোখে হলিডে মার্কেটকে গ্রামীণ হাট বলে মনে হয়। সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সলিমুল্লাহ রোডেছবি: জাহিদুল করিম

জীবনের প্রতিটি দিনই হলিডে হতে পারে—তা মার্কিন গায়ক বিল উইদারসের ‘লাভলি ডে’ গানটি শুনলেই বোঝা যায়। নাগরিক ঠাসবুনটের ভিড়ে, প্রিয় মুখের উপস্থিতি একটি দিনকে যে সুন্দর ও প্রাঞ্জল করে তুলতে পারে, গানটির কথা ও সুরে তা–ই বলা হয়েছে।

সম্প্রতি ঢাকার মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লাহ রোডের হলিডে মার্কেটে গিয়ে কথা হয় রিশাদ জামানের সঙ্গে। অনেকটা বিলের গানের কথার মতো বলছিলেন তাজমহল রোডের এই বাসিন্দা। বললেন, ‘সল্লিমুল্লাহ রোডের এই মাঠে সপ্তাহের প্রতি রোববার হলিডে মার্কেট বসে। এটি আমাদের কাছে নাগরিক মেলার মতো। খোকার বাঁশি থেকে রুটির বেলনা, হলিডে মার্কেটে সবই পাওয়া যায়। নাগরিক ব্যস্ততার মধে৵ও এ দিনটির জন্য আমি অপেক্ষা করি। মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার সময় নিয়ম করে মেলায় ঢুঁ মারি। টুকটাক কেনাকাটার মধে৵ দেখা হয় একঝাঁক প্রিয়মুখের সঙ্গে। এদের কেউ হয়তো মাস দুয়েক আগেই আমার পাশের ফ্ল্যাটে থাকতেন। ছিলেন ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। দিনটা সুন্দর হয়ে যায় তখন।’

সকাল থেকে রাত

মায়ের হাত ধরে ছেলে, বন্ধুবান্ধব দল বেঁধে, কেউবা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসেছেন হলিডে মার্কেটে। মাঠটি বালিতে আবৃত। পলিথিনের ওপর চাদর বিছিয়ে নানা পণ্যের ঝাঁপি খুলে বসেছেন দোকানিরা। মেলায় আগত ব্যক্তিরা কেউ ঘুরে দেখছেন, কেউ কিনছেন। অনেকে কেনাকাটার ফাঁকে খোশগল্পে মেতে উঠছেন।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সলিমুল্লাহ রোডের পাশের তাজমহল রোড, বাবর রোড, ইকবাল রোড, হ‌ুমায়ূন রোডের বাসিন্দারা মেলায় নিয়মিত আসেন। বৃহত্তর মোহাম্মদপুরের আবাসিক এলাকা শেখেরটেক, বছিলা, মোহাম্মদী হাউজিং, বায়তুল আমান হাউজিংয়ের বাসিন্দারাও হলিডে মার্কেটে নিয়মিত আসেন।

২০২০ সাল থেকে সাপ্তাহিক এই বাজারে নিয়মিত দোকান নিয়ে বসেন তানজিব আহমেদ। থাকেন কামরাঙ্গীরচরে। নারীদের লং ও শর্ট গেঞ্জি বিক্রি করেন। তিনি জানান, সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত এখানে বেচাবিক্রি হয়। শতাধিক দোকানি হলিডে মার্কেটে এক দিনে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেন।

শিশুদের খেলনা থেকে গৃহস্থালির টুকিটাকি-সবই পাওয়া যায় হলিডে মার্কেটে
ছবি: প্রথম আলো

পাওয়া যায় সবই

সাপ্তাহিক এই বাজার ঘুরে দেখা যায়, সাজগোজের অনুষঙ্গ থেকে ঘর সাজানো, খেলনা, ব্যাগ, শাড়ি, নারী ও শিশুদের পোশাক, বিছানার চাদর, বাসনকোসন, মগ, চামচ, সুই-সুতা, জীবনযাপনের খুঁটিনাটি প্রায় সবকিছুর পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। এর মধ্যে কিছু জিনিসের সংগ্রহ নজরকাড়া, নান্দনিক ও মানসম্মত। কিছু পণ্য মানহীন। তবে পণ্যের দাম অন্যান্য বাজারের তুলনায় প্রায় অর্ধেক।

হস্তশিল্পের নান্দনিক পণ্য নিয়ে ডেমরা থেকে এসেছেন নারী উদ্যোক্তা সুরমা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, ‘আমরা ঘর সাজানোর কর্নার বাস্কেট, শিকা বাস্কেট, প্লেসমেট, রাউন্ড ট্রে ও ওয়্যারমেট পরিবেশবান্ধব উপকরণ দিয়ে নিজেরাই তৈরি করি।’ ৫০ থেকে ৩০০ টাকা দরে প্রতিটি পণ্য বিক্রি করছিলেন তিনি।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দোকানের বিস্তৃতি সলিমুল্লাহ রোডের মাঠ পেরিয়ে উত্তর ও পশ্চিম পাশের সড়কে ছড়িয়ে পড়ে। মাঠের চারপাশজুড়ে রয়েছে কড়ই ও কৃষ্ণচূড়া গাছের সারি। সবুজ ছায়ায় মাঠজুড়ে চলছে বিকিকিনি। বাজারটিতে নারীদের থ্রি–পিস, টু-পিস, ওয়ান পিস, শাড়ি, ব্যাগ, বিছানার চাদর, ঘরের পর্দা, লেইসের দোকানের আধিক্য দেখা গেছে। ১০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ হাজার–বারো শ টাকায় পণ্যগুলো বিক্রি হচ্ছিল।

একটি লেইসের দোকানে সুঁই-সুতা কিনছিলেন শেখেরটেকের তৃষা সরকার। তিনি বলেন, ‘আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে গ্রামে। গ্রামীণ হাটে যেমন সবকিছু পাওয়া যায়, এই হলিডে মার্কেটও তেমন। গৃহস্থালির টুকিটাকি অনেক কিছুই পাওয়া যায়। মা বাড়ি থেকে এসেছেন। বদ্ধ নগরীতে তাঁর সময় কাটছে না। নকশিকাঁথা সেলাই করবেন। তাঁর জন্য সুই-সুতা কিনছি। আর ছেলে বায়না ধরেছে মাটির খেলনা হাতি কিনবে। সেটি খুঁজছি; কিন্তু পাচ্ছি না। রায়েরবাজারের কুমোর দাদু মনে হয় আজ আসেনি। আমরা মজা করে বলি, এই মার্কেটে আলপিন থেকে এলিফ্যান্ট, সবই পাওয়া যায়।’

কেউ কেউ বিরক্ত

শুক্র-শনি ছুটির পর সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস রোববার। সলিমুল্লাহ রোডের মাঠে এই দিনই হলিডে মার্কেটটি চালু থাকে।

বাজারটি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এলাকাবাসী। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এই বাজারকে কেন্দ্র করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার জটে বিরক্ত এলাকার অনেক মানুষ। সলিমুল্লাহ রোডের স্থায়ী বাসিন্দা মঈনুল হক চৌধুরী বললেন, মাঠটি এই এলাকার বাসিন্দাদের শরীরচর্চা ও খেলাধুলার জন্য ব্যবহৃত হওয়ার কথা। এটি সাময়িক সময়ের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে; কিন্তু স্থায়ীভাবে মাঠটিতে মার্কেট চলতে পারে না।

ব্যাগ, শাড়ি থেকে জুতা জীবনযাপনের খুঁটিনাটি-প্রায় সবকিছুর পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা
ছবি: প্রথম আলো

আরও বাজারের খোঁজ

সলিমুল্লাহ রোডের মাঠের হলিডে মার্কেটে মোহাম্মদ ইয়াসিনের ওয়ান পিস, টু–পিস ও থ্রি–পিসের দোকানটি বেশ জনপ্রিয়। নিয়মিত ক্রেতারা এক নামে দোকানটি চেনেন। ১৮ মে দোকানটি ঘিরে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। দোকানটিতে ওয়ান পিস ১০০ টাকা, টু–পিস ২০০ ও থ্রি–পিস ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল।

কথা প্রসঙ্গে মোহাম্মদ ইয়াসিন ঢাকা শহরে বর্তমানে চালু থাকা পাঁচটি হলিডে মার্কেটের খোঁজ দিলেন। তিনি জানান, সলিমুল্লাহ ছাড়াও মোহাম্মদপুরের জাকির হোসেন রোড খেলার মাঠে সোমবার, মোহাম্মদপুর সেকশন মাঠে মঙ্গলবার, রামপুরার মেরাদিয়ায় বুধবার ও মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনের রাস্তায় শুক্রবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হলিডে মার্কেট চালু রয়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এসব মর্কেটে ঘুরে ঘুরে পণ্য বিক্রি করেন।

সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ

ঢাকার ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদে ব্যর্থ হয়ে ২০০৭ সালে রাজধানীজুড়ে হলিডে মার্কেট চালু করে ঢাকা সিটি করপোরেশন। তখন সরকারি ছুটির দিনগুলোতে রাজধানীর বেশ কিছু এলাকায় হকারদের ব্যবসা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। দু–এক বছর পর উদ্যোগটি বন্ধ হয়ে যায়। এর পর ২০১৬ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করেপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) পৃথকভাবে স্থান নির্ধারণ করে হলিডে মার্কেট চালু করে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তথ্য কর্মকর্তা ফারজানা ববি সম্পত্তি বিভাগের বরাত দিয়ে টেলিফোনে বলেন, ৫ আগস্ট–পরবর্তী সময়ে হলিডে মার্কেটগুলোর কার্যক্রম সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে না। তবে মাঠগুলো সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা নিয়মিত ঝাড়ু দেয়, পরিষ্কার করে। হকার পুনর্বাসন নিয়ে সিটি করপোরেশন নতুন করে পরিকল্পনা সাজাচ্ছে।

কম দামে গৃহস্থালির সব পণ্যই এলাকাবাসীর হাতের নাগালে। তাই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হলিডে মার্কেটে ক্রেতাদের ভিড় লক্ষ করা যায়। সম্প্রতি সলিমুল্লাহ রোড মাঠে
ছবি: প্রথম আলো

ব্যবসায়ীরাও চান স্থায়ী সমাধান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পূর্ববর্তী সময়ে হলিডে মর্কেটের শতাধিক দোকানিকে প্রতি হাটে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা চাঁদা দিতে হতো। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এই চাঁদা সংগ্রহ করতেন। বর্তমানে দোকান থেকে কেউ চাঁদা সংগ্রহ করছেন না; কিন্তু বন্ধ চাঁদাবাজি যেকোনো দিন চালু হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা।

‘একদিন ঠিকমতো ব্যবসা না হলে সংসার চালানো কঠিন হয়ে যায়। আজ বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় প্রতিজ্ঞা করেছি, যা–ই বিক্রি হোক প্রথমে মায়ের জন্য ওষুধ কিনব, তারপর বাড়ির খরচ।’ বলছিলেন, হলিডে মার্কেটটির নিয়মিত ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইউনুস। তিনি জানান, দোকানে কোন ছাউনি নেই, বৃষ্টি হলে বিক্রি-বাট্টা বন্ধ থাকে। এ ছাড়া প্রতি হাটে ভ্যানে করে মাল আনা-নেওয়ায় হাজার টাকার মতো খরচ হয়ে যায়। ব্যবসায়ীরা চান স্থায়ী সমাধান। দুই সিটি করপোরেশন এলাকাভিত্তিক স্থায়ীভাবে হকার্স মার্কেট করে দিলে হকারদের জীবন ও জীবিকার অনিশ্চয়তা দূর হয়। কয়েক হাজার পরিবার ভাত–কাপড়ের নিশ্চয়তা পায়।