গ্যাস–সংকট সমাধানে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ চায় সরকার

রাজধানীর পেট্রো সেন্টারে ‘গ্যাস চাহিদা-সরবরাহ পরিস্থিতি: দেশীয় খনিজ সম্পদ উৎপাদন বাড়াতে ত্রিমাত্রিক জরিপের সুযোগ ও অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার’ শীর্ষক সেমিনারে আলোচকেরাছবি: বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সৌজন্যে

গত দুই দশকে দেশের জ্বালানি খাত গুরুত্ব পায়নি। জ্বালানির চিন্তা না করেই একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। দীর্ঘ সময়ে বিদ্যুৎ খাত এগিয়েছে অনেক। এরপর দেখা দিয়েছে জ্বালানির সংকট। দেশীয় প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর না দিয়ে আমদানির দিকে গেছে সরকার। ডলার–সংকটের চাপে পড়ে এখন দেশীয় গ্যাসের জন্য হাহাকার করছে।

‘গ্যাস চাহিদা-সরবরাহ পরিস্থিতি: দেশীয় খনিজ সম্পদ উৎপাদন বাড়াতে ত্রিমাত্রিক জরিপের সুযোগ ও অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার’ শিরোনামে রাজধানীর পেট্রো সেন্টারে আয়োজিত সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন। দেশের গ্যাস খাতের বিশেষজ্ঞ, ভূতত্ত্ববিদ, সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের মতামত জানতে এ সেমিনারের আয়োজন করে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)।

এতে দিনের প্রথম অধিবেশনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ১৯৮০ সালে একটি এলাকায় দ্বিমাত্রিক জরিপ করা হলো। এর ৩৯ বছর পর ত্রিমাত্রিক জরিপ করা হয়েছে। এত লম্বা সময় কেন বসে থাকল। যে কাজ পারবে না, তাকে সরিয়ে দিতে হবে। বাপেক্স শত বছর ধরে কাজ করবে, আর তার জন্য সব ফেলে রাখা হবে; এটা হতে পারে না। বাপেক্সেরও একটা প্রতিযোগিতা থাকতে হবে।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী বলেন, দেশের বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্রের মজুত কমে আসছে। তাই উৎপাদনও কমছে। দু-তিন বছর কমতে থাকবে। এরপর আবার বাড়বে। তাই পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। চার বছরে ৪৬ কূপ, এরপর আরও ১০০ কূপ খননের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সব কূপের জন্য সময়সীমা নির্ধারিত থাকতে হবে। সময়সীমা ছাড়া পরিকল্পনা হয় না।

একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বিশেষজ্ঞদের সবার প্রতি নসরুল হামিদ বলেন, গঠনমূলক আলোচনা হোক। সমালোচনা না করে সবাই এগিয়ে আসুন। দেশের গ্যাস দরকার। বিদ্যুৎ খাতে চাহিদামতো গ্যাস দিতে পারলে ভর্তুকি ৭০ শতাংশ কমে যাবে। এ ছাড়া গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাস না দিয়ে টাকা নিচ্ছে বলে সমালোচনা আছে। বিতরণ কোম্পানিকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব নূরুল আলম বলেন, আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এখন দুটি ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে সরবরাহ করা হচ্ছে। এরপরও গ্যাসের ঘাটতি হচ্ছে। ভবিষ্যতে আমদানি আরও বেড়ে গেলে গ্যাসের মূল্য কোথায় গিয়ে ঠেকবে! সর্বোত্তম প্রক্রিয়া বেছে নেওয়া হবে। তাই সবাইকে মতামত ও পরামর্শ দিতে আহ্বান জানান তিনি।

গ্যাস উৎপাদনে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার
প্রথম অধিবেশনের শুরুতে পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে মূল নিবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, দেশে ২৯টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এর সম্ভাব্য মজুতের পরিমাণ ৩৮ দশমিক ২১ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট)। তবে উত্তোলনযোগ্য মজুত হচ্ছে ২৯ দশমিক ৭৪ টিসিএফ। যার মধ্যে গত বছর পর্যন্ত ২০ দশমিক ৭২ টিসিএফ উত্তোলন করা হয়েছে। আর বাকি আছে ৯ টিসিএফ। মজুতের ৭০ শতাংশ গ্যাস ইতিমধ্যে তোলা হয়ে গেছে। বর্তমানে দেশীয় গ্যাস থেকে আসছে ৭৬ শতাংশ, যার মধ্যে ৪৭ শতাংশ সরবরাহ করছে বহুজাতিক কোম্পানি। আর ২৪ শতাংশ গ্যাস আসছে আমদানি করা এলএনজি থেকে।

গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের একটি প্রক্ষেপণ তৈরি করেছে পেট্রোবাংলা। এতে বলা হয়, ২০২৯-৩০ অর্থবছরে দিনে গ্যাসের চাহিদা হতে পারে ৬৬৫ কোটি ঘনফুট। তবে বিতরণ কোম্পানির মতে, একই সময়ে গ্যাসের চাহিদা হবে ৫০৯ কোটি ঘনফুট। ওই চাহিদার বিপরীতে ৪৩৫ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হতে পারে বলে মনে করছে পেট্রোবাংলা। যার মধ্যে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে ২১২ কোটি, এলএনজি থেকে ২১৩ কোটি ও সমুদ্র থেকে ১০ কোটি ঘনফুট উৎপাদন ধরা হয়েছে। যদিও সমুদ্রে এখন পর্যন্ত কোনো গ্যাস আবিষ্কৃত হয়নি।

তবে নিবন্ধ বলা হয়েছে, গ্যাসের চাহিদা পূরণে নিজস্ব গ্যাস উৎপাদনে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে বাংলাদেশ। তাই নতুন নতুন কূপ খনন করা হচ্ছে। সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য শিগগিরই দরপত্র আহ্বান করা হবে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকায় দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক জরিপ পরিচালনা করা হবে। এর বাইরে এলএনজি সরবরাহ বাড়াতে তিনটি নতুন টার্মিনাল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি সরবরাহে তিনটি চুক্তি করা হয়েছে, আরেকটি চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সেমিনারে নিবন্ধ উপস্থাপন করেন বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ারুল ইসলাম ও পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপক (রিজার্ভ অ্যান্ড ডাটা ম্যানেজমেন্ট) মেহেরুল হাসান।

প্রকল্প অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রতা
সেমিনারে অধিকাংশ বক্তা সরকারের প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার সমালোচনা করেন। তাঁরা বলেন, আগে যে সিদ্ধান্ত তিন দিনে হয়ে যেত, এখন তিন মাসেও হয় না। প্রতিটি কাজের জন্য উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরি করা হয়; এর একটি অনুমোদনে এক বছরও লেগে যায়। গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর কোনো প্রকল্প গত দুই দশকে গুরুত্ব দিয়ে নেওয়া হয়নি। বাপেক্সের পাশাপাশি বিদেশি কোম্পানিকে কাজে লাগিয়ে অনুসন্ধান জোরদার করা দরকার। প্রয়োজনে দরপত্র ছাড়াও চুক্তি করা যেতে পারে।

এর মধ্যে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, প্রকল্প নিতে আগে তৃতীয় পক্ষ দিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কথা বলা হয়। এটি একটি সময়সাপেক্ষ ও অর্থ খরচের ব্যাপার। এ ছাড়া গ্যাস কূপ খনন করে গ্যাস পাওয়া যেতেও পারে, না–ও পাওয়া যেতে পারে। এর সম্ভাব্যতা যাচাই করে কী হবে। নিজেদের বিশেষজ্ঞ দিয়ে ১৫ দিনে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন তৈরি করে দেওয়া যায়। কিন্তু এ বিষয়টি জ্বালানি বিভাগ ও পরিকল্পনা কমিশনকে তিন দফা চিঠি দিয়েও বোঝানো যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সাবেক সদস্য মকবুল-ইলাহী-চৌধুরী বলেন, বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্র থেকে দিনে ৪০ থেকে ৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে ২০১১ সালে। এটি ধরে কোনো কাজ হয়নি।

বাপেক্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মর্তুজা আহমেদ ফারুক বলেন, গ্যাস অনুসন্ধান না করার পেছনে অর্থায়ন দায়ী নয়, দায়ী সরকারের নীতি। বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে অনুসন্ধানকাজে সরকারের কোনো খরচ নেই। ২০০২ থেকে সমুদ্রে বহুমাত্রিক জরিপ পরিচালনার উদ্যোগ শুরু হয়। মাত্র সেটা শেষ হয়েছে। আসলে জ্বালানিতে ওইভাবে নজর দেওয়া হয়নি। এখন ডলার–সংকটের কারণে জ্বালানি উন্নয়ন করতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ চায় পেট্রোবাংলা
শুরুতে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, উন্নয়নের চালিকা শক্তি হচ্ছে গ্যাস। গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহে ঘাটতির কারণে সমালোচনা হচ্ছে; তাই সবাইকে পরামর্শের জন্য ডাকা হয়েছে। দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর দিকে জোর দিতে চায় পেট্রোবাংলা। চলমান ৪৬টি কূপ খননের পাশাপাশি ২০২৮ সালের মধ্যে আরও ১০০টি কূপ খনন করা হবে। এরপর দ্বিতীয় অধিবেশনে তাঁর সঞ্চালনায় বিশেষজ্ঞদের মতামত ও পরামর্শ নেওয়া হয়। গত দুই দশকে এমন পরামর্শ সভার উদ্যোগ দেখা যায়নি বলে মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ।

ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম বলেন, এখন গ্যাসের জন্য হাহাকার চলছে। কিন্তু গ্যাস তো এত সহজ নয়। গ্যাস অনুসন্ধানের ঝুঁকি নিয়ে মানসিকতা বদলাতে হবে। ভারতের রাজস্থানে ১২টি কূপ খনন করেও গ্যাস পাওয়া যায়নি। এরপর ১৩ নম্বর কূপে গ্যাস মিলেছে। অনুসন্ধানে এ ঝুঁকিটা থাকেই। দেশের পার্বত্য এলাকায় ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও তা চরম অবহেলিত হয়েছে। অথচ একই এলাকা ধরে সীমান্তের ওপারে ত্রিপুরা ৯টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে।

বঙ্গোপসাগরে গ্যাসের ব্যাপক সম্ভাবনার কথা জানান পেট্রোবাংলার সাবেক কর্মকর্তা মো. ফরিদ উদ্দিন। তিনি বলেন, সমুদ্রে মার্কিন কোম্পানি কনোকোফিলিপসের চালানো দ্বিমাত্রিক জরিপের তথ্য তিনি দেখেছেন। এতে ৭ টিসিএফ গ্যাসের সম্ভাবনা পেয়েছে তারা। পার্বত্য চট্টগ্রামেও বেসরকারি খাতকে দিয়ে দ্রুত অনুসন্ধান শুরু করা দরকার।