ঢাকায় ডেঙ্গুর লার্ভা জরিপ নিয়ে বিতর্ক

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জরিপে দক্ষিণ সিটিকে নিশানা করা হয়েছে বলে অভিযোগ।

ডেঙ্গু মশাপ্রতীকী ছবি

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ডেঙ্গু মশার লার্ভা (শূককীট) নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জরিপ করে যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। এ জরিপকে একপেশে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা ফজলে শামসুল কবির। তাঁর কথা, বিতর্কিত ব্যক্তিকে দিয়ে দক্ষিণ সিটিকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্যই এ জরিপ করা হয়েছে। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জরিপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা।

সাধারণত বৃষ্টি শুরু হলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে। গত বছর (২০২৩) দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে যে মৃত্যু এবং আক্রান্ত হয়েছে তা আগের ২৩ বছরে হয়নি। জনস্বাস্থ্যবিদ ও কীটতত্ত্ববিদদের অনেকের আশঙ্কা, আগাম ব্যবস্থা না নিলে এবারের পরিস্থিতি গতবারের চেয়েও ভয়ানক হতে পারে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যে জরিপ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি, সেখানেও ডেঙ্গু লার্ভার উপস্থিতি গতবারের চেয়ে তিন গুণের বেশি  পাওয়া গেছে। এখন সেই জরিপ নিয়ে সরকারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের ভিন্ন মত ‘খারাপ উদাহরণ’ সৃষ্টি করল বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন।

ডেঙ্গু সংক্রমণ শুরুর এ সময়ে এখন সরকারের সব দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় সবচেয়ে জরুরি। এ সময় জরিপের ফলাফল নিয়ে ভিন্ন অবস্থান খারাপ উদাহরণ তৈরি করল।
মুশতাক হোসেন, জনস্বাস্থ্যবিদ

জরিপ ও ফলাফল

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা প্রতিবছর রাজধানীতে বর্ষার আগে, বর্ষার সময় এবং পরে তিন দফায় লার্ভার জরিপ করে। এ জরিপের ফলাফল তারা দুই সিটির কাছে দিয়ে দেয়। এবার বর্ষার আগের জরিপ প্রকাশ করা হয় এপ্রিল মাসে। ফল জানানো হয় ২৮ মে। জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুই ওয়ার্ডের ১৪ শতাংশের বেশি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। গত বছর বর্ষার আগের এমন জরিপে ৪ শতাংশ বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গিয়েছিল।

আরও পড়ুন

এডিস মশার ঘনত্বের সূচককে বলা হয় ব্রুটো ইনডেক্স। এর হার ২০–এর বেশি হলে তাকে ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। দেখা যায়, দক্ষিণের ২৯টি ওয়ার্ড এবং উত্তরের ১২টি ওয়ার্ড ঝুঁকিপূর্ণ।    

জরিপ নিয়ে দুই সিটির ভিন্ন অবস্থান

জরিপের ফলাফল নিয়ে দক্ষিণ সিটির স্বাস্থ্য কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই রিপোর্ট আমরা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছি; কিন্তু এটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এই যে ২৯টি ওয়ার্ডকে ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়েছে, এক মাসে সেগুলোতে তন্নতন্ন করে এসব ওয়ার্ডে দু-একজনের বেশি রোগী খুঁজে পাইনি। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়েছে যে ১৩ নম্বর ওয়ার্ডকে, সেখানে এক মাসে একটি রোগীও পাওয়া যায়নি। যদি এই ২৯টি ওয়ার্ড ঝুঁকিপূর্ণ হতো, তাহলে এসব ওয়ার্ড ডেঙ্গু রোগীতে সয়লাব হয়ে যাওয়ার কথা।’

দক্ষিণের সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তার আরও গুরুতর অভিযোগ আছে। ফজলে শামসুল কবির বলেন, ‘এমন এক ব্যক্তিকে দিয়ে সার্ভেটি (জরিপটি) করানো হয়েছে, যিনি একটি সিটি করপোরেশনের লাভজনক পদে জড়িত। এবং সেই সিটি করপোরেশন থেকে অসংখ্য সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেছেন। কাজেই তাঁর হাত থেকে কোনো নিরপেক্ষ সার্ভে হতে পারে তা আমরা বিশ্বাস করি না। আমাদের বিশ্বাস, তিনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে খারাপ দেখিয়েছেন।’

জরিপের ফল নিয়ে নানা অভিযোগ থাকলেও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন বলে জানান এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।

উত্তর সিটি করপোরেশন অবশ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই প্রতিবেদনকে খুব ইতিবাচকভাবে নিয়েছে বলে জানান প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী।

দক্ষিণ সিটির অভিযোগ খণ্ডন

জরিপ এবং জরিপের নেপথ্যের ব্যক্তিকে নিয়েই দক্ষিণ সিটির যত অভিযোগ। এসব অভিযোগের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক শেখ দাউদ আদনান বলেন, দক্ষিণ সিটি ভুল বুঝেছে। জরিপ হয়েছে বাসাবাড়িতে। এসব বাসাবাড়ি যদি নোংরা থাকে, তবে এর দায় তো সিটি করপোরেশনের না। কাউকে হেয় করার জন্য জরিপ হয়নি।

দক্ষিণ সিটির স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জরিপের নেপথ্যের ব্যক্তির নাম উল্লেখ না করলেও তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশারকেই ইঙ্গিত করেছেন, এমনটাই মনে করেন শেখ দাউদ আদনান। তিনি বলেন, কবিরুল বাশার স্বনামধন্য অধ্যাপক। তিনি মশার জরিপের বিষয়ে দক্ষ। তাঁকে আমাদের উচ্চ স্তর থেকেই মনোনীত করা হয়েছিল।

 অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ‘আমি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপে নেতৃত্ব দিইনি। এক দিন জরিপের কাজে মাঠে থেকেছি; কিন্তু কখনোই সম্পৃক্ত ছিলাম না। এমনকি যেদিন এর ফল তুলে ধরা হলো, সেদিনও ছিলাম না। আমার অকারণ অভিযোগ আনা হয়েছে।’

খারাপ উদাহরণ

চলতি বছরে (৩১ মে পর্যন্ত) দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৮৫৩ জন। আর গত বছর এ সময়ে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৯২৭ জন। এ বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৩৬ জন মারা গেছেন। গত বছর এ সময় মারা গিয়েছিলেন ১৩ জন। গত বছরের সর্বোচ্চ সংক্রমণের বছরের চেয়েও এবারের সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে শঙ্কিত গবেষকেরা। এর মধ্যে ডেঙ্গুর লার্ভার জরিপ নিয়ে সরকারের দুই সংস্থার পারস্পরিক অভিযোগকে অনাকাঙ্ক্ষিত বলেছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তৌহিদউদ্দিন আহমেদ। খ্যাতনামা এই কীটতত্ত্ববিদ অবশ্য মনে করেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যে নমুনা নিয়ে কাজ করে তা অপর্যাপ্ত। সেখানে সঠিক চিত্র উঠে আসে না। তাই সেটা নিয়ে অনেক সময় প্রশ্ন ওঠে। 

ডেঙ্গু সংক্রমণ শুরুর এ সময়ে এখন সরকারের সব দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় সবচেয়ে জরুরি বলে মনে করেন জনস্বাস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন। তাঁর কথা, ‘এ সময় জরিপের ফলাফল নিয়ে ভিন্ন অবস্থান খারাপ উদাহরণ তৈরি করল।’