ভবনের অগ্নিঝুঁকি কমাতে একক নীতিমালার প্রস্তাব

গুলশান সোসাইটি আয়োজিত ‘আগুন প্রতিরোধ ও নিরাপত্তা: আমাদের সম্প্রদায়ের সুরক্ষা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা। গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলেছবি: খালেদ সরকার

ভবনের অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়গুলো সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেভাবে তদারক করে না। ভবনমালিক কিংবা ব্যবসায়ীরাও জানেন, দুর্ঘটনা ঘটলে তাঁদের কিছু হবে না, হয়ও না। এসব কারণে সারা দেশের ভবনগুলো অগ্নিঝুঁকিমুক্ত করা যাচ্ছে না। সিটি করপোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও ফায়ার সার্ভিস মিলে একক নীতিমালা বা নির্দেশিকা করে ভবনের অগ্নিঝুঁকি কমাতে কাজ করতে হবে।

‘আগুন প্রতিরোধ ও নিরাপত্তা: আমাদের সুরক্ষা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় এসব বিষয় উঠে এসেছে। আজ শনিবার বিকেলে রাজধানীর গুলশান-২ নম্বরে একটি হোটেলে এই আলোচনার আয়োজন করে গুলশান সোসাইটি।

এই আয়োজনে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, বিদেশিদের চাপে তৈরি পোশাক কারখানা অনেকটাই নিরাপদ করা সম্ভব হয়েছে। এতে কারখানা কমেছে, কিন্তু ব্যবসা বেড়েছে। একইভাবে আগুনের নিরাপত্তার জন্য চাপ তৈরি করতে হবে। নিরাপত্তা তৈরি করে ব্যবসায় টিকে থাকতে পারলে থাকবে, না পারলে থাকবে না। কারণ, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা এর সঙ্গে জড়িত।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর মিলে একক নীতিমালা বা নির্দেশিকা তৈরির প্রস্তাব দেন মেয়র। তিনি বলেন, ‘নিজেরা মিলে যদি একটা গাইডলাইন তৈরি করতে পারি, তাহলে আর কোনো সমস্যা হবে না। আলাদা গাইডলাইন হলে ভবনমালিকেরা দিশাহারা হয়ে যাবেন। তখন তাঁরা “ম্যানেজ” করে চলার চেষ্টা করবেন। কিন্তু মানুষ যেন ব্যবসা করতে পারে এবং আমাদের ভবনও যেন নিরাপদ হয়।’

মেয়র বলেন, যেসব ভবনের নকশায় ভূগর্ভস্থ গাড়ি পার্কিং দেখানো হয়েছে, সেসব গাড়ি পার্কিংয়ে শপিং মল বা বাজার থাকতে পারবে না। ঈদের পর গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় শপিং মল বা বাজার থাকলে অভিযান চালানো হবে। তিনি বলেন, এটা হচ্ছে আরেকটি মরণফাঁদ। ওখানে আগুন লাগলে বেরিয়ে আসার জায়গা নেই।

গোলটেবিল আলোচনায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, আগুন লাগার সবচেয়ে বড় কারণ হলো শর্টসার্কিট, গ্যাস লিকেজ (ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া) ও ধূমপান। এই তিন কারণ রোধ করা গেলে ৭০ ভাগ অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ করা সম্ভব। গুলশান এলাকায় কতগুলো ভবন আগুনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে, তা ৩০ এপ্রিলের মধ্যে জানানো যাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

অনুষ্ঠানে ডিজিটাল উপস্থাপনা করেন গুলশান সোসাইটির সহসভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির। উপস্থাপনায় তিনি বলেন, ২০২২ সালে ২৪ হাজারের বেশি বা প্রতি মাসে ২ হাজারের বেশি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৩৮ ভাগের আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে। এর সাড়ে ছয় হাজারের বেশি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে বাসাবাড়িতে। সারা দেশে ছয় শতাধিক ভবনকে ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এক হাজার ছয় শর বেশি ভবনকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলা হয়েছে। শুধু ঢাকাতেই ১৩৪টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান নগর–পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, জরুরি বহির্গমন পথ বন্ধ থাকে। এতে আগুন লাগলে নামার সুযোগ না পাওয়ায় হতাহত বেশি হয়। তিনি বলেন, ‘বাসাবাড়িতে যেসব গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয়, সেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ কি না, সেটা কে টেস্ট করছে? সেটা তো আমরা তদারক করছি না।’

রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন) উজ্জ্বল মল্লিক বলেন, বিভিন্ন ভবনে যে গ্লাস ব্যবহার করা হয়, তা চিমনির মতো ব্যবহৃত হয়। নিচে আগুন ধরার সঙ্গে সঙ্গে তা ওপরের তলায় চলে যায়। এমন গ্লাস ব্যবহার করে যে তা ভাঙাও যায় না। তখন উদ্ধারকাজ আরও কঠিন হয়ে যায়। সুতরাং ভবনের উপাদানগুলো কী হবে, সে বিষয়ে ভাবার পরামর্শ দেন তিনি।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মঈন উদ্দিন বলেন, ‘আমরা সবাই জানি, কী করতে হবে। এ বিষয়ে নিজেদের উপলব্ধি গুরুত্বপূর্ণ। গুলশান সোসাইটিকে ধন্যবাদ জানাই, তারা বুঝতে পেরেছে। এটা আমাদের নিজেদের মধ্য থেকে শুরু করতে হবে।’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, মানুষের প্রবণতা হচ্ছে কত কম খরচে বেশি আউটপুট বের করতে পারে। সে কারণে মানুষ একটি ভবনে দুটি সিঁড়ি দেয় না। এই প্রবণতা থেকে মানুষ সহজেই বেরিয়ে যাবে, এটা বলা যাবে না। সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে এসব নিশ্চিত করতে হবে। বিদ্যালয় পর্যায় থেকে আগুন বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।

এই আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন গ্রিন ডেলটা ইনস্যুরেন্স কোম্পানির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ ফরহাদ আব্বাস হোসেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, ‘নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে অগ্নিঝুঁকির বিমা দেওয়া বন্ধে আপনারা কতটা কঠোর হতে পারবেন?’
জবাবে সৈয়দ ফরহাদ আব্বাস হোসেন বলেন, ‘আমরা বিমা না দিলেও দেশে অনেক বিমাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাই আইন করে যদি বলে দেওয়া হয় তখন সবাইকে তা মানতে হবে, আমরাও মানব।’

২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসে আগুনের ঘটনায় এখনো প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য নেওয়া শেষ হয়নি উল্লেখ করে গুলশান সোসাইটির সদস্য কামরান বকর বলেন, ভবনমালিকেরা জানেন, তাঁদের কিছু হবে না। আগুনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে বিচার নিশ্চিত করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

এই আয়োজনের সভাপতিত্ব করেন গুলশান সোসাইটির সভাপতি ওমর সাদাত। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ভবন আগুনের নিরাপত্তা পরীক্ষা করা হলে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন তিনি। ওমর সাদাত বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে মালিকদের দায়িত্ব ও অধিকারের তালিকা দেওয়া হলে তা প্রতিটি ভবনে সাঁটিয়ে দেওয়া হবে।

গোলটেবিল আলোচনার সঞ্চালনা করেন গুলশান সোসাইটির আখতার মতিন চৌধুরী। এ সময় আরও বক্তব্য দেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পরামর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আমিরুল ইসলাম, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভলিউম জিরোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়েজ উল্লাহ প্রমুখ।