আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে রং নিয়ে মনের খেলায় মেতে উঠল শিশুরা

‘রংতুলিতে ভালোবাসি বাংলাদেশ’ শিরোনামের আয়োজনে ছবি আঁকে শিশুরাছবি: দীপু মালাকার

পাঁচ বছরের জারীর হাসান আয়ানের আঁকা ছবির প্রাণীটিকে ‘বাঘিংহ’ বললে খুব একটা ভুল হবে না। কারণ, প্রাণীটির গায়ে যেমন বাঘের ডোরাকাটা আছে, তেমনি তার মাথায় আছে সিংহের মতো কেশর।

জারীর অবশ্য জানিয়েছে, এটা বাঘ-ই। জারীরের নিজস্ব ভাবনায় আঁকা এই প্রাণীর সঙ্গে পরিচয় হয় ‘রংতুলিতে ভালোবাসি বাংলাদেশ’ শিরোনামের শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায়।

আজ ২১ ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ঢাকার মাদানী অ্যাভিনিউর ইউনাইটেড সিটির শেফস টেবিল কোর্টসাইডের প্রথমা বুক ক্যাফে প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম আলো আয়োজিত এ প্রতিযোগিতা।

সকাল নয়টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত চলা এ প্রতিযোগিতায় জারীরের মতো অপরিসীম কল্পনাশক্তিতে ভরপুর শিশুরা অংশ নেয়। প্রথমা বুক ক্যাফের সৌজন্যে আয়োজিত এ প্রতিযোগিতায় ৫ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুরা অংশ নিয়ে রং নিয়ে মনের খেলায় মেতেছিল। শিশুমনের বিচিত্র সব ভাবনা রংতুলিতে প্রকাশ পায়। এই প্রকাশভঙ্গির কোনো ব্যাকরণ নেই।

কল্পনার হাতি তো আকাশেও ওড়ে! তাই জারীরের বাঘ বড় গাছের চেয়েও বড়। সেই বাঘের পিঠে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা হাতে দুই শিশু আনন্দ করছে।

তুলির আঁচড়ে রঙের খেলা

গাছের ছায়ায় ম্যাটের ওপর আসন গেড়ে ছয় বছরের আরিশা আফশিন গভীর মনোযোগ দিয়ে ছবি আঁকছিল। তার কোলে বসে ছিল একটা কালো বিড়ালের ছানা। প্রথমে মনে হয়েছিল, আরিশা হয়তো তার পোষা বিড়ালসহ এসেছে। তবে আরিশা জানাল, বিড়ালটা তার আশপাশেই ছিল। হুট করে তার কোলে এসে বসেছে। বিড়াল সে ভয় পায় না, ভালোবাসে। বিড়ালপ্রেমী আরিশার আঁকার বিষয়বস্তু ছিল রঙিন ঘর, মেঘ, সূর্য, এক পাশে শহীদ মিনার, তার নিচে পার্ক। আরিশার ছবির সূর্য গোলাপি রঙের।

প্রতিযোগিতার বিচারক শিল্পী ফারেহা জেবা বললেন, শিশুরা নিজের মতো করে ছবি আঁকবে, সৃষ্টি করবে, মনের মাধুরী মিশিয়ে রং করবে, এতেই তার সৃজনশীলতা বাড়বে। শিশুদের ওপর কখনো মুখস্থ কিছু চাপিয়ে দিতে নেই। প্রতিযোগিতার বিষয়বস্তু উন্মুক্ত হওয়ায় শিশুরা নিজেদের মতো আঁকার স্বাধীনতা পেয়েছে। এ ধরনের আয়োজন শিশুদের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবস সম্পর্কে ধারণা দেয়, ভাবতে শেখায়।

সৃজনশীলতার বিষয়ে শিল্পী ফারেহা জেবার কথার সত্যতা শিশুদের আঁকার বিষয়বস্তু দেখে আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায়। যেমন গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের ছাত্র সপ্তক দাসের (৮) আঁকা ছবিতে শহীদ মিনারের ঠিক পাশেই ছিল একটা পড়ার টেবিল। তাতে বসে বই পড়ছিল কয়েকটি শিশু। বই পড়া শিশুদের ঠিক পেছনেই আরেক শিশু ঘুড়ি ওড়াচ্ছে।

ছবি আঁকাতেই যে মজা, তা দেখা গেল হাজী ইউসুফ আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী ফাবলিহা ফাইজার চোখমুখ দেখে। শহীদ মিনারের পেছনে বড় একটি সূর্য এঁকেছে সে। নির্ধারিত সময়ের আগেই তার ছবি আঁকা শেষ। বাবা নাইজুল ইসলাম শামীমের সঙ্গে এসেছে ফাবলিহা। সে জানাল, ছবি আঁকাতে তার খুবই ভালো লাগছে।

স্যার জন উইলসন স্কুলের ছাত্রী সৈয়দা মাইমুনা নেসা (৪) জানাল, সে একটা রোলারম্যান এঁকেছে। তার রোলারম্যান সূর্যের সঙ্গে ঝুলছে। আর একটা গাছ আঁকতে চাইছে সে।

সাড়ে ৩ বছরের ফাবলিহা মোস্তাক তার বড় বোন সাড়ে ৬ বছরের ফারহিনা মোস্তাকের পাশে বসেই ছবি আঁকছিল। ফাবলিহার আঁকা নদীতে নৌকার চেয়ে শাপলা ছিল বড়।

প্রতিযোগিতায় ‘নবিশ’ আঁকিয়েদের পাশাপাশি মিথিলা ভৌমিক, অথয় গোস্বামীর মতো ‘দক্ষ’ অনেক শিশুরও দেখা পাওয়া গেল।

একই সময়ে রাজধানীর ধানমন্ডির সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে প্রথম আলোর আয়োজনে ‘বর্ণমেলা’ চলছিল। তবে বাসার কাছে সেই অনুষ্ঠান রেখে মাদানী অ্যাভিনিউর আয়োজনে দুই ছেলেকে নিয়ে এসেছেন রোকসানা হোসেন। তিনি বললেন, ‘গাছপালা আছে, জায়গাটা সুন্দর, ছেলেরা এখানেই আসতে চাইল। তাই আসা।’

ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আরও অনেক মা–বাবা তাঁদের শিশুদের নিয়ে এ আয়োজনে এসেছিলেন। ধানমন্ডি থেকে সন্তানকে নিয়ে এসেছিলেন বাবা উজ্জ্বল দাস। আবার নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছিল তাকওয়া মল্লিক রিদওয়া।

অভিনয়শিল্পী দিলারা জামান শিশুদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে ছুটে এসেছিলেন। তিনি বললেন, বয়স ৮১ বছর হলেও ছোট শিশুদের সঙ্গ তাঁর ভালো লাগে। তাদের সঙ্গে ছুটতে তাঁর মন চায়। প্রথম আলোর এমন আয়োজনের প্রশংসা করে তিনি বলেন, এ ধরনের আয়োজনের মাধ্যমে প্রাণের ক্ষুধা মেটাতে পারে শিশুরা। এখন তো অনেক স্কুলে মাঠ পর্যন্ত নেই। ফলে শিশুরা বাড়িতে থাকে। প্রকৃতির মাঝে না এলে শিশুদের মন বড় হয় না।

আয়োজনে চিত্রাঙ্কন ছাড়াও শিশুদের জন্য সিসিমপুর, জলপুতুলের পাপেট শো, শিল্পী সানজিদা মাহমুদ নন্দিতা ও পুলক অধিকারীর গান, অর্জুন চক্রবর্তীর আবৃত্তি, জাদুশিল্পী রাজীব বসাকের পরিবেশনা ছিল।

এ ছাড়া বর্ণমেলা আয়োজনের অংশ গানের প্রতিযোগিতার সেরা ১০ জন গেয়েছিল অমর একুশের ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়কারী মাহবুবা সুলতানা।

শিশুদের নিয়ে অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ায় মা-বাবাসহ অভিভাবকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি বলেন, প্রথম আলো স্বপ্ন দেখে অন্যায়, অবিচারমুক্ত সুন্দর পরিবেশে বড় হবে নতুন প্রজন্ম। এই প্রজন্মের সবকিছুর সঙ্গী হতে চায় প্রথম আলো। পাঠকই প্রথম আলোর শক্তি ও সাহস।

প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সুমনা শারমীন বলেন, রংতুলিতে শিশুরা সুন্দর একটা সকাল উপহার দিয়েছে। সংস্কৃতির ধারায় বড় হয়ে উঠুক দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।

বিজয়ী হলো যারা

চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের ঋষভ শীল হৃদ্ধি। দ্বিতীয় কর্ডোভা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের কেজির ছাত্র জারীর হাসান আয়ান। তৃতীয় তিন বছর বয়সী রুজাইনা মারিফা।

এ ছাড়া বিশেষ পুরস্কার পেয়েছে ১০ জন। তারা হচ্ছে প্লে পেন স্কুলের আরূশি হাসনাত, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের ঋষিত শীল ধৃতি, সানিডেল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শীর্যা স্মরণিকা, বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুলের সানজিদা আফরিন, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের গাজী আয়েশা সিদ্দিকা, চেঞ্জেস ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের তাকওয়া মল্লিক রিদওয়া, উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অথয় গোস্বামী, সাউথ পয়েন্ট স্কুলের প্রিয়ন্তী সাহা, এসওএস হারম্যান মেইনার স্কুলের ফারহিনা মোস্তাক ও ঘাসফুল শিশু পাঠশালার ফাবলিহা মোস্তাক।

বিজয়ী শিশুদের বই পুরস্কার দেওয়া হয়।